খুনের এক নিষ্ঠুর কাহিনী! জন্মদাতা মা-বাবাকে খুন
দেশের খবর: বাবা-মায়ের খুনের দায় নিলেন ঐশী রহমান। গতকাল দুপুরে পল্টন থানায় নিজে আত্মসমর্পণের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী দাবি করেছেন, খুনের আগে বাবা-মাকে কফির সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে অচেতন করার পর নিজেই দু’জনকে খুন করেছেন। এরপর লাশ বিছানার চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে বাথরুমে রেখে আসেন। তবে তার এই বক্তব্য বিশ্বাস করেনি গোয়েন্দা পুলিশ। কারণ দু’জনকে ঐশীর একার পক্ষে খুন করে লাশ সরানো অনেকটাই অসম্ভব। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় চামেলীবাগের ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার পর থেকে দম্পতির একমাত্র মেয়ে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনালের ও’ লেভেলের ছাত্রী ঐশী রহমান ও তাদের বাসার গৃহকর্মী সুমী বেগম নিখোঁজ ছিলেন।
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) মনিরুল ইসলাম গতকাল রাতে সাংবাদিকদের বলেন, ঐশী একাই এই হত্যাকাণ্ডের দায় নিলেও তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রনিকে (জনি) আটক করা হয়েছে। কারণ ঘটনার পর থেকে রনির সঙ্গে ঐশী সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ করেছেন। তাই রনিকে সন্দেহের মধ্যে রাখা হয়েছে। ইয়াবাতে আসক্ত ঐশীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রনি লেখাপড়া করেনি। পুরনো ঢাকায় বখাটে হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কও ছিল। গতকাল বিকালে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে রনিকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ।
গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন গোয়েন্দারা। এর মধ্যে ছয়জন বর্তমানে গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। এরা হলেন— ঐশী রহমান, গৃহকর্মী সুমী, ঐশীর বান্ধবী তৃষা, ঐশীর বন্ধু রনি ও অপর দু’জন। এই দু’জন কে তাদের পরিচয় গোয়েন্দা পুলিশ নিশ্চিত করেনি। মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এক ডজন লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা সবাই যে অভিযুক্ত তা বলা যাবে না। পুলিশ একজন সিএনজি চালককে আটক করেছে।’
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ওই সিএনজি চালকের বাসাতেই ছিল গৃহকর্মী সুমী বেগম। সিএনজি চালক পুলিশকে জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে পুরনো ঢাকায় যাবে বলে তার সিএনজি ভাড়া করে ঐশী (১৭)। তার সঙ্গে ছিল ভাই ঐহী (৭) ও গৃহকর্মী সুমী (১০)। কিন্তু দিনভর তারা পুরনো ঢাকায় ঘুরে নির্দিষ্ট ঠিকানা খুঁজে পায়নি। ফলে ঐশী তাকে (সিএনজি চালক) অনুরোধ করে সুমিকে যেন তার বাসাতেই এক রাতের জন্য আশ্রয় দেন। সিএনজি চালক তার কথায় রাজি হয়ে সুমিকে তার বাসায় রাতে রেখে দেন। সেখান থেকেই গতকাল পুলিশ সুমীকে উদ্ধার করেছে। তবে সুমী হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কোন তথ্য দিতে পারেনি।
সুমীকে রাখার পর ছোট ভাইকে নিয়ে রাত ৮টার দিকে কাকরাইলে বান্ধবী তৃষার বাসায় যান ঐশী। সেখানেই রাতযাপনের পর শুক্রবার সকালে বের হন। তৃষাও পুলিশের কাছে জানিয়েছেন, ঐশী যখন তার বাসায় যায়, তাকে তখন বিধ্বস্ত লাগছিল। কিন্তু কি কারণে ঐশী বিধ্বস্ত বা রাতে কেনই বা বাসায় ফিরবে না সে ব্যাপারে তৃষাকে সে কিছুই বলেনি। ঐশী জানিয়েছেন, তৃষার বাসা থেকে বের হয়ে শুক্রবার সকালে ছোট ভাইকে সিএনজিতে তুলে দিয়ে তিনি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়িয়েছেন। তবে শুক্রবার রাতে তিনি কোথায় ছিলেন বলেননি।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঐশীর কথা অসংলগ্ন। মাঝে মধ্যে সে উল্টো পাল্টা বলছে। ফলে তার সব কথা বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। কিভাবে বাবা-মাকে হত্যা করেছে— এমন প্রশ্নের জবাবে ঐশী বলেছে, রাত সোয়া ১১টার দিকে তার বাবা অফিস থেকে ফেরার পর সবাই একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে। এরপর বাবা কফি খাইতে চাইলে সে নিজেই বানানোর কথা বলে। আগে থেকে কিনে আনা চেতনা নাশক ওষুধ কফির সঙ্গে মিশিয়ে বাবা-মাকে খেতে দেয়। কফি খাওয়ার পরই তারা দু’জনই বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তখন গৃহকর্মী ও ছোট ভাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। এরপর সে বাসায় থাকা বটি ও চাকু দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে বাবা-মাকে হত্যা করে।
তদন্তকারী ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বাবা-মাকে হত্যার আগে সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে ইয়াবা খেয়েছেন বলে স্বীকার করেন ঐশী। ওই আড্ডায় রনিও ছিল। ইয়াবা খাওয়ার কারণে লাশ সরাতে তার কোন সমস্যা হয়নি। তবে ঐশীর এই বক্তব্য বিশ্বাস হচ্ছে না গোয়েন্দাদের। সে কি কারো সাজানো বক্তব্য দিচ্ছে না নিজেই বলছে তা এখনই পরিষ্কার হওয়া যায়নি। তবে বখাটে রনির সঙ্গেই ঐশীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ইয়াবা খাওয়া ও বখাটের সঙ্গে প্রেম কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি ঐশীর বাবা-মা। তাই মাঝে মধ্যেই ঐশীকে মারধর করতেন তার মা। ফলে মায়ের উপরই ঐশীর ক্ষোভ ছিল বেশি। তাই মাকে ১১টি কোপ দিয়েছেন। আর বাবাকে দিয়েছে তিনটি কোপ।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ও লেভেল’ পড়ুয়া ঐশীর আচরণে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব ছিল। বখাটে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে মেলা-মেশার কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল। মাঝে-মধ্যেই বিভিন্ন ছেলে নিয়ে বাসায় আসতো। এসব বিষয় নিয়ে মায়ের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব চলছিল। পিতা পুলিশের পরিদর্শক হওয়ায় বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকতেন। ছেলে-মেয়েদের খোঁজ-খবর নিতে পারতেন না; কিন্তু মেয়ের এমন আচরণের তথ্য পাওয়ার পর তিনি মেয়ের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এ নিয়ে পিতা-মাতা উভয়ের সঙ্গে ঐশী ও তার কথিত বন্ধুদের ঝগড়া চলছিল।
এদিকে গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়না তদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ জানান, মাহফুজুর রহমানের গলায় এবং পেটে ছুরিকাঘাতের তিনটি চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার শ্বাসনালী এবং পাকস্থলি কেটে গেছে। এছাড়া স্বপ্নার শরীরে ছুরির ১১টি চিহ্ন পাওয়া গেছে। ছুরিকাঘাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তার মৃত্যু হয়।
বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড শাহীন জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে ঐশী তার ছোট ভাই ও গৃহকর্মীকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় ওই বাড়ির ম্যানেজার আমজাদ হোসেন পিতা-মাতার অনুমতি ছাড়া তাদের বাইরে যেতে বাধা দেন। একইসঙ্গে মাহফুজুর রহমানের স্ত্রী স্বপ্না রহমানের মোবাইল ফোনে কল করেন তিনি। তখন ওই মোবাইল ফোন থেকে বলা হয়, ‘আমি রাজশাহী আছি। ওদের যেতে দাও।’ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মায়ের মোবোইল ফোন তখন ঐশীর কাছেই ছিল। মায়ের ফোন বাজতে থাকলে সে কৌশলে গেট থেকে সরে গিয়ে আমজাদের কল রিসিভ করে। মায়ের কণ্ঠ নকল করে মেয়েদের বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
ম্যানেজার আমজাদ হোসেন বলেন, গত ৪ আগস্ট বাড়ি ভাড়া নেয়ার জন্য ঐশীদের বাসায় যাই। তখন পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ে নিয়ে সমস্যায় আছি। যখন-তখন ওকে বাইরে বের হতে দিও না। তারপরও যেতে চাইলে ওর মাকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিও।’
নিহত মাহফুজুর রহমানের পিতার নাম মরহুম মতিউর রহমান ওরফে মতিন মাস্টার। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মাহফুজ ছিলেন সবার বড়। গতকাল বাদ সন্ধ্যা ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট থানার মরাগাঙ্গকান্দা গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে পুলিশ দম্পতির লাশ দাফন করা হয়েছে। এর আগে দুপুরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
ঐশীর চাচা মশিউর রহমান রুবেল বলেন, মেয়ে যে বখে গেছে তা তার ভাই তাকে ফোনে জানিয়েছিলেন; কিন্তু সেই বখে যাওয়ার কারণে এতবড় ঘটনা ঘটতে পারে তা তিনি কোনভাবে বিশ্বাসই করতে পারছেন না।
গ্রামের বাড়ীতে শোকের মাতম
আমাদের হালুয়াঘাট সংবাদদাতা জানান, ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার খন্দকপাড়া গ্রামে চলছে শোকের মাতম। নিহতের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে হূদয় বিদারক দৃশ্য। ছেলে হারানোর বেদনায় বৃদ্ধা মা জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন তার ভাই হারা বোনগুলো।
প্রতিবেশীদের বক্তব্য- একি হলো, এমন একজন ভালমানুষকে মানুষ এভাবে খুন করতে পারে। হালুয়াঘাটের মধ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মৃত আব্দুল মতিন (মতিন মাস্টার)-এর বড় ছেলে মো. মাহফুজুর রহমান বাবুল ১৯৮৯ সালে পুলিশের উপ-পরিদর্শক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। শুরুতে রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলায় চাকরি করতে গিয়ে সিদ্দিকুর রহমানের কন্যা স্বপ্না রহমানের সাথে পরিচয় এবং পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ে। ১৯৯৫ সালে প্রথম কন্যা সন্তান ঐশীর জন্ম হয়। ২০০৩ সালে ছেলে সন্তান ঐহী জন্ম লাভ করে। দুই সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়াই ছিল যাদের স্বপ্ন, ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার সমস্যা হবে বিধায় ঢাকার বাইরে চাকরি করতে যাননি মাহফুজ।
দুইবার জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যোগ দিতে দেশের বাইরে গিয়ে উপার্জিত অর্থে ঢাকার রামপুরায় একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। অফিস এবং ছেলে-মেয়েদের স্কুল থেকে নিজস্ব ফ্ল্যাট দূরত্ব হওয়ায় চামেলীবাগে ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি।
Category: 1stpage, দেশের খবর, শীর্ষ সংবাদ