গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করছে ঐশী : সন্তানদের নিয়ে আতঙ্কে পুলিশের বহু পরিবার
দেশের খবর: বহুল আলোচিত এসবি ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যার ঘটনায় আটক মেয়ে ঐশী রহমান গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপনের চেষ্টা করছে। জেরায় সে খুব চালাকির পরিচয় দিচ্ছে বলে জানা গেছে। গতকাল ঐশীকে জিজ্ঞাসাবাদের চতুর্থ দিন পার হলো। তার শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। সে বিষণ্ন মনে ছিল।
বুধবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার বয়স ও শরীরের বিভিন্ন অংশের এক্স-রে করা হয়। এরপর সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। জিজ্ঞাসাবাদের চতুর্থ দিনে কর্মকর্তাদের আবারও বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে ঐশী। তাকে আবার রিমান্ডে নেয়া যায় কিনা—তা ভেবে দেখছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ঐশীকে জিজ্ঞাসাবাদে নিয়োজিত একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে ঐশীকে নিয়ে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছেন। তারা তাদের পরিবারের সন্তানদের নিয়েও আতঙ্কের মধ্যে আছেন।
গতকাল সকালে ঐশীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা। তবে ঐশী বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছে। ঐশীর পাশাপাশি তার বয়ফ্রেন্ড মিজানুর রহমান রনি এবং বাড়ির গৃহপরিচারিকা খাতিজা খাতুন সুমিরও রিমান্ড শেষ হবে আজ।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ঐশীর শরীরের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। সে বিভিন্ন সময় বিভিন্নরকম বক্তব্য দিচ্ছে। তাকে আবার রিমান্ডে নেয়া যায় কিনা, তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, সে শুরুতে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিলেও পরে খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে এবং খুনের ঘটনার সঙ্গে অন্য লোক জড়িত থাকার কথাও বলেছে। কিন্তু এ খুনের সঙ্গে আর কারা জড়িত, তাদের নাম সে বলতে চাচ্ছে না। ঐশীর বয়ফ্রেন্ড ড্যান্স পার্টনার মিজানুর রহমান রনিকে আটকের পর সে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা সম্পর্কে তথ্য দেয়। তবে উভয়ের বক্তব্যে মিল পাওয়া যায়নি।
তবে ঐশী কার হাত ধরে মাদকের অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে—সে বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। এখন শুধু ঐশীর দুই বয়ফ্রেন্ড সাইদুল ও জনিকে গ্রেফতার করলে এ চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা উদ্ঘাটিত হবে। তাদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে এবং এ ব্যাপারে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা দুজন যেন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে যেতে না পারে, সেজন্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে।
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও জানান, ঐশী ও রনি এবং কাজের মেয়ে সুমির বক্তব্য ভিডিও রেকর্ড করা হচ্ছে। এসব মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হবে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া ও জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান জানান, ঐশী রিমান্ডের চতুর্থ দিনে খুব চালাকির পরিচয় দিয়েছে। পুলিশ তাকে খুব সতর্কতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তার কাছ থেকে তথ্য আদায়ের ব্যাপারে আর কোনো চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে না। গতকাল তার কাছ থেকে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও বলেন, তার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। বুধবার বিকালে তার বয়স পরীক্ষা ও শরীরের কয়েক স্থানের এক্স-রে করা হয়। তবে ঐশী তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত এবং সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ঐশীর বয়ফ্রেন্ড সাইদুল ও জনিকে আটক করার জন্য পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে বলে তিনি জানান।
অনুতপ্ত ঐশী : স্কুলজীবন থেকে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে ঐশী রহমান। বিষয়টি পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন বেশ পরে। ততক্ষণে ঐশী ভালোভাবেই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তার ছিল অসংখ্য বয়ফ্রেন্ড। শপিং ও ঘুরে বেড়ানোর নাম করে সে বাবা-মায়ের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। কোনো কোনো মাসে সে বাবা-মায়ের কাছ থেকে লাখ টাকারও বেশি নিয়েছে। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ইয়াবা সেবন করে গভীর রাতে সে বাসায় ফিরত। বাবা-মা টাকা খরচের হিসাব জানতে চাইলে সে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করত।
বাবা-মা বাসায় না থাকলে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে ইয়াবা ট্যাবলেট ও বিভিন্ন মাদক সেবনের আসর বসাত। তাকে সত্ ও লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য তার বাবা-মা সব চেষ্টাই করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের! তারা ঐশীকে সঠিক পথে ফেরাকে ব্যর্থ হয়েছেন।
গতকাল গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে ঐশী তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে এবং কান্নায় ভেঙে পড়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে সে জানিয়েছে, বাবা-মা তাকে সঠিক পথে ফেরানোর জন্য সব চেষ্টাই করেছেন। কিন্তু সে তাদের কোনো কথাই শোনেনি বরং সব সময় মা-বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহারই করেছে।
যে নেশা জীবনের জন্য কাল হলো, সেই নেশার ঘোরেই রয়েছে সে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে থেকেও সে মাদকের জন্য ছটফট করছিল। মাঝেমধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। যে কোনো মূল্যে একটি ইয়াবা ট্যাবলেটের জন্য বার বার পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে কাকুতি-মিনতি করেছে ঐশী। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ছে সময় সময়। খাওয়া-দাওয়ার চাহিদা না থাকলেও নেশাসামগ্রীর জন্য সে পুলিশ কর্মকর্তাদের আংকেল, মামা-চাচা ডেকে হাতে-পায়ে ধরেছে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিবারে আতঙ্ক : ঐশীর বিষয় নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিবারে হতাশা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গতকাল ডিএমপির ক’জন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা এ হতাশার কথা ব্যক্ত করেন।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ঐশীর ঘটনার পর পুলিশের বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে বড় একটা খারাপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে জনসাধারণের মাঝে গুডউইল নেই। ‘ইমেজ সঙ্কটে’ রয়েছে পুলিশ। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, নিহত পুলিশ কর্মকর্তা মাসিক কত টাকা বেতন পেতেন? কোথা থেকে তিনি মেয়েকে প্রতিমাসে ৭০-৮০ হাজার টাকা হাতখরচ দিতেন! ঐশী ঘটনার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আতঙ্কে আছেন। কেননা, একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার ছেলেমেয়ের প্রতিকৃতি ঐশীর মতো। তারা ছেলেমেয়েদের এখন থেকে চোখে চোখে রাখার উদ্যোগ নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর চামেলীবাগের চামেলী ম্যানশনের ষষ্ঠতলার বাসা থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে বুধবার রাতে তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যার পর ওই দম্পতির মেয়ে ঐশী রহমান তার ছোট ভাই ঐহি রহমান এবং গৃহকর্মীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। শনিবার দুপুরে ঐশী পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করলে পুলিশ বাবা-মাকে হত্যার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার দেখায়।
Category: 1stpage, দেশের খবর, শীর্ষ সংবাদ