সিরিয়া প্রসঙ্গে জার্মানির নীতি সাবধানী ও সতর্ক
ইউরো সংবাদ: জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন যখন দ্য হেগ-এর ‘শান্তি প্রাসাদের’ শতবার্ষিকী উদযাপন করছেন, তখন সারা বিশ্ব রুদ্ধশ্বাসে সিরিয়ার উপর পশ্চিমা হানার অপেক্ষায় রয়েছে৷ সে ক্ষেত্রে জার্মানির অবস্থান কী হবে, তাই নিয়েই জবর আলোচনা৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তাদের কাছে সিরিয়া সরকারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ‘‘অকাট্য” প্রমাণ আছে এবং ওয়াশিংটন নাকি সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত৷ সেই সামরিক পদক্ষেপ যে দিন দুয়েকের মধ্যে সাঙ্গ হবে, এমন একটা খবরও বাজারে ঘুরছে৷
ব্রিটেন এবার সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে নিতে চলেছে৷ বুধবার ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ বলেছেন যে, সিরিয়া সরকার স্বদেশের জনগণের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার পর ব্রিটেন যদি কোনো চ্যালেঞ্জ না জানায়, তাহলে ব্রিটেনের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে৷
জাতিসংঘে সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত বাশার আল-জাফারি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে, তারা বিদেশি শক্তিদের সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্ররোচিত করার জন্য নিজেরাই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে৷
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ পশ্চিমা জগতকে সাবধান করে দিয়েছেন যে, আসাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান গোটা মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে৷ অপরদিকে রাশিয়া সিরিয়া থেকে বেশ কিছু রুশ নাগরিককে স্থানান্তরিত করতে শুরু করেছে – যদিও সিরিয়ায় হাজার হাজার রুশ নাগরিকের বাস৷
সাবধানের মার নেই
জার্মান সরকার চোখে পড়ার মতো সাবধানতার নিয়ে সিরিয়া প্রসঙ্গে নিজেদের অবস্থান জ্ঞাপন করছেন – অথবা করছেন না৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল দৃশ্যত অন্যান্য পশ্চিমা নেতৃবর্গের মতোই এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, আসাদ প্রশাসন রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে৷ এবং তার ফলশ্রুতিও আসাদ প্রশাসনকে ভোগ করতে হবে, এ কথাও তিনি তাঁর সরকারি মুখপাত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন৷ জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডো ভেস্টারভেলে বলেছেন: ‘‘রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার প্রমাণিত হলে, আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসমাজকে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ সে ক্ষেত্রে যারা ন্যায্য ফলশ্রুতি কামনা করে, জার্মানি তাদের দলে থাকবে৷”
তবে সেই ‘‘ফলশ্রুতি” কী হবে কিংবা হতে পারে, তাতে জার্মানি অংশ নেবে কিনা, অথবা নিলেও কী ভাবে নেবে – চ্যান্সেলর কিংবা তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেটা খুলে বলেননি৷ সিরিয়া সম্পর্কে জার্মানির বিবৃতি ‘‘অস্পষ্টতায়” বাকি সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে, বলে অভিযোগ করেছেন হামবুর্গের মধ্যপ্রাচ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান গিগা–র অন্দ্রে বাঙ্ক৷
‘‘জার্মানির সিরিয়া নীতিতে কোনো বাস্তবিক নিজস্ব অবস্থান নেই৷” নীতিগতভাবে জার্মানি পশ্চিমা জোট-মিত্রদের সঙ্গে একমত৷
সাবধানতার কারণ আছে
জার্মানির সাবধানতার কারণ আছে৷ সামনে সংসদীয় নির্বাচন৷ ইরাক-যুদ্ধে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার ও তাঁর এসপিডি দল সেবার ভোটে জিতেছিলেন বটে, কিন্তু জার্মান-মার্কিন সম্পর্কের উপর ঐ সিদ্ধান্তের ছাপ পড়েছিল৷ ২০১১ সালে জার্মানি ও তার ন্যাটো জোট-সহযোগীদের মধ্যে আবার মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়, যখন বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদে লিবিয়া সংক্রান্ত ভোটে জার্মানি ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে৷
সিরিয়ার ক্ষেত্রে জার্মানি সে ভুল করতে রাজি নয়৷ সিরিয়া সংক্রান্ত রাজনীতিতে জার্মানি অপরাপর ইউরোপীয় দেশের নীতির সঙ্গে পা মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে, যদিও শেষমেষ দেখা যাচ্ছে যে, জার্মানি ফ্রান্স কিংবা ব্রিটেনের তুলনায় আরেকটু নরম৷ যেমন সিরীয় বিদ্রোহীদের অস্ত্র দেবার প্রশ্নে৷ বার্লিন সিরীয় বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিতে প্রস্তুত নয়, কিন্তু বুলেট-প্রুফ জ্যাকেট ইত্যাদি সরঞ্জাম ও মানবিক সাহায্য প্রদান করে তাকে৷
চাই রাজনৈতিক সমাধান
জার্মানির প্রায় সব রাজনৈতিক দলের রাজনীতিকরাই এখনও সিরিয়া সংঘাতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের কথাই বলে চলেছেন, এবং সেটা শুধু সামনে সংসদীয় নির্বাচন আছে বলে নয়৷ বিশেষ করে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ও সিরিয়ার বাইরে উদ্বাস্তুদের মানবিক পরিস্থিতি নিয়েই তাঁদের চিন্তা৷
অপরদিকে ‘‘বিদ্রোহ শুরু হবার সময় থেকেই জার্মানি সিরিয়ায় একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নবসূচনার জন্য কাজ করে গেছে,” বলেছেন সিডিইউ দলের সংসদীয় গোষ্ঠীর পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত মুখপাত্র ফিলিপ মিসফেল্ডার৷ ‘‘চিরকালই লক্ষ্য ছিল, আসাদ শাসনের অন্তের পর সিরিয়ার নতুন ভবিষ্যৎ গড়ায় সাহায্য করা৷”
জার্মানি প্রায় সূচনা থেকেই সিরিয়ায় বিরোধীপক্ষকে সমর্থন করে আসছে৷ সিরীয় বিদ্রোহীদের জাতীয় জোটকে ‘‘সিরীয় জনগণের বৈধ প্রতিনিধি” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জার্মান সরকার৷ জার্মানি ‘‘সিরীয় জনগণের বান্ধব গোষ্ঠীর” সদস্য৷ ‘‘জাতীয় জোট” বার্লিনে একটি কার্যালয় খুলেছে৷ গত মার্চ মাসে জার্মান সরকার ঘোষণা করেন, জার্মানি পাঁচ হাজার সিরীয় উদ্বাস্তুকে জার্মানিতে আশ্রয় দিতে প্রস্তুত৷ তবে উদ্বাস্তু ত্রাণে এ যাবৎ বিশ কোটি ইউরো পরিমাণ অর্থসাহায্য ‘‘পি-নাটস”, বলে জার্মান বিশেষজ্ঞদের ধারণা৷
সামরিক পদক্ষেপ?
জার্মানির সিরিয়া নীতির পুরোভাগে রয়েছে মানবিক সাহায্য এবং সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা৷ কিন্তু তা বলে পশ্চিমের সামরিক পদক্ষেপে জার্মানি যে একেবারেই সংশ্লিষ্ট হবে না, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না৷ জার্মানি যদি ‘‘ফ্রন্ট লাইনে” নাও থাকে, সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণের অন্যান্য নানা পন্থা আছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা৷ যেমন তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ইতিমধ্যেই জার্মান পেট্রিয়ট রকেট প্রণালী বসানো আছে৷
Category: 1stpage, আন্তর্জাতিক, ইউরো সংবাদ, ইউরো সংবাদ, ইউরো-সংবাদ - German, শীর্ষ সংবাদ