• ১৩ বৈশাখ ,১৪৩১,26 Apr ,2024
  • ব্রেকিং নিউজ : বাংলাদেশের রিকশাচিত্র পেল ইউনেস্কোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি

ফ্ল্যাট কিনে, চুক্তি করে হয়রানির শিকার মানুষ: প্রায় ১৩০০ অভিযোগ

| সেপ্টেম্বর 4, 2013 | 0 Comments

দেশের খবর: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আসাদ উল্লাহ আল হোসেন, গোপালগঞ্জের ফজিলাতুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ কাজী আখতারুজ্জামান ও সরকারি কর্মকর্তা শাহ আলমগীর। সম্মানিত এই তিন ব্যক্তিকে ডাকাতি মামলার আসামি হয়ে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। মাইহোম লিমিটেড নামের একটি আবাসনপ্রতিষ্ঠান থেকে ফ্ল্যাট কেনার পর তাঁদের এ পরিণতি।শুধু এই তিনজনই নন, ফ্ল্যাট কিনে কিংবা চুক্তি করে অনেক মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত দেড় শ থেকে দুই শ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক হাজার ২৯১টি অভিযোগ জমা পড়েছে।ওই তিন ব্যক্তির মতো অনেকেই বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করেন। তাঁদের অভিযোগ, রিহ্যাবে লিখিত আবেদন করেও কোনো সুরাহা পাননি তাঁরা।তবে রিহ্যাব বলছে, তারা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অভিযোগের মীমাংসা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ওই তিনজনসহ অনেকেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আদালতই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। রিহ্যাবের পরিসংখ্যান যাচাই করে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত জমা পড়া অভিযোগের অর্ধেকেরও বেশির কোনো সমাধান হয়নি। রিহ্যাবের তথ্য অনুযায়ী, জমা পড়া অভিযোগগুলোর মধ্যে ৫৬৮টির নিষ্পত্তি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জবাবের অপেক্ষায় আছে ২০০ অভিযোগ। ২৭৭টি অভিযোগ আপস-মীমাংসার প্রক্রিয়াধীন। আদালতে বিচারাধীন ১২টি অভিযোগ। ২২৩টি অভিযোগের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না। বাকি ১১টি অভিযোগের ব্যাপারে কোনো তথ্য মেলেনি।

মাইহোম লিমিটেড: ভুক্তভোগী আসাদ উল্লাহ, আখতারুজ্জামান ও শাহ আলমগীর বলেন, ২০১০ সালে তাঁরা তিনজন মিরপুর টোলারবাগে প্রকল্পাধীন একটি ভবনের ফ্ল্যাট কেনার জন্য মাইহোম লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি অনুযায়ী তাঁরা নির্দিষ্ট সব টাকা পরিশোধ করেছেন, কিন্তু ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল না। বরং তাঁদের কাছ থেকে আরও অতিরিক্ত টাকা দাবি করা হয়। এ অবস্থায় তাঁরা গত বছরের ৮ অক্টোবর দারুস সালাম থানায় প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমান চেয়ারম্যান) মনিরুল হক ভূঁইয়া ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক) সওগাত মোরশেদ মাহমুদের (রাশেদ) বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেন। এরপর তাঁরা নিজেরাই অর্ধনির্মিত অবস্থায় ফ্ল্যাটে উঠে যান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা তাঁদের বিরুদ্ধে ডাকাতি মামলা করেন। এ মামলার পর করা হয় উচ্ছেদ মামলাও। পুলিশের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত দুই মামলা থেকেই তাঁদের অব্যাহতি দেন।

ভুক্তভোগী ওই তিনজন জানান, এমনিতেই ফ্ল্যাটে প্রায় ৩০ লাখ টাকার মতো কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ করার কোনো নামগন্ধ নেই। উপরন্তু মুঠোফোনে হত্যার হুমকিসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে তাঁদের। এ বিষয়ে রিহ্যাবে অভিযোগ করেও কোনো সমাধান মেলেনি। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা তাঁদের কেনা ফ্ল্যাট অনেকের কাছে বিক্রি করার পাঁয়তারা করেছেন। এরই মধ্যে তাঁদের দুজনের কেনা ফ্ল্যাট ওসমান গনি নামের আরেকজনের কাছে বিক্রির চুক্তিও করেছে মাইহোম কর্তৃপক্ষ।

যোগাযোগ করা হলে ওসমান গনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে ওই বাড়ির দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ তলাটি নিবন্ধন করে দিয়েছেন মনিরুল ও রাশেদ। কেনার পর জানতে পারি, তা আগেই বিক্রি করা হয়েছে। আমি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।’

যোগাযোগ করা হলে মাইহোম লিমিটেডের বর্তমান চেয়ারম্যান মনিরুল দাবি করেন, ওই তিন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সুফিয়ানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। সব ঝামেলার দায় সুফিয়ানের।

তবে আবু সুফিয়ান বলেন, ‘শুধু ওই তিন ব্যক্তি নন, অন্তত আরও ৫০ জন গ্রাহক মনিরুল ও রাশেদের প্রতারণার শিকার। এসব কারণে আমি প্রতিষ্ঠান থেকে সরে আসতে বাধ্য হই।’

মিরপুর অঞ্চলের উপকমিশনার (ডিসি) ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, অচিরেই ওই আবাসনপ্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হওয়া প্রতারণা মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

মাল্টিপ্ল্যান ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড: প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইসমাইল আলী ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাফির উদ্দিনের বিরুদ্ধে রাজউকের অনুমোদনের আগেই গ্রাহকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া, নির্দিষ্ট সময়ে ফ্ল্যাট তৈরি না করে টাকা দাবি, গ্রাহকদের হয়রানি করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগে হাবিবুর রহমান নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক গত বছরের ১৬ অক্টোবর আদাবর থানায় মামলা করেন। প্রায় একই অভিযোগে একই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ফারুক আহমেদ নামের একজন।

হাবিবুর রহমানের অভিযোগ, এ ব্যাপারে রিহ্যাবে অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা মেলেনি। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। বিভিন্নজনের কাছে এ বিষয়ে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ করেন। শেষমেশ মামলা তুলে নেওয়ার শর্তে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা তাঁকে ২২ লাখ টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন। তবে ফারুকের অভিযোগের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

রিহ্যাব সূত্রে জানা গেছে, এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গ্রাহকের আরও অন্তত সাতটি অভিযোগ জমা পড়েছে।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাফির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাবিবুরের সঙ্গে মীমাংসা হয়েছে। অভিযোগকারী ফারুকের সঙ্গেও মীমাংসা করা হবে।’

প্রাইম লাইফ ডেভেলপারস লিমিটেড: এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে বাড়ি বানানোর চুক্তি করে প্রতারণা, হামলা-ভাঙচুরসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে। জায়গা বিক্রির নামে প্রতারণার একটি অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১২ সালের ১৩ অক্টোবর তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

রাজধানীর পল্লবীর বাসিন্দা খলিলুর রহমান বলেন, এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজ জায়গায় বাড়ি বানানোর চুক্তি করে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন তিনি। রাজউকের অনুমোদনের জন্য জমা দেওয়া কাগজপত্রে সাইফুল দলিল ও হোল্ডিং নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য গোপন করেন। এর প্রতিবাদ করলে সাইফুলের পক্ষে কয়েকজন সন্ত্রাসী তাঁর বসতবাড়িতে ভাঙচুর চালায়। এ ব্যাপারে মামলা করেও কোনো ফল পাননি তিনি। পরে রাজউকে অভিযোগ করলে প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র বাতিল করা হয়।

এখন নকশা অনুমোদন বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে বলে রাজউক সূত্রে জানা গেছে। তবে সাইফুল আলমের দাবি, ভুল রাজউকই করেছিল।

সাইফুলের বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে সরকারি জমি বিক্রির আরও অভিযোগ আছে।

ব্যালেন্স ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড: এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সময়মতো ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেওয়া, জমির মালিককে হুমকি-ধমকি, চাঁদা দাবিসহ বিভিন্ন প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে ২০১০ ও ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতে ও মোহাম্মদপুর থানায় মামলাও করেছেন মনোয়ারা বেগম নামের এক ভুক্তভোগী। একটি মামলায় পুলিশ দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। পরে জামিনে বের হয়ে রাজধানীর লালমাটিয়ার কার্যালয় বন্ধ করে গা-ঢাকা দেন দেলোয়ার ও অন্য কর্মকর্তারা। সম্প্রতি দেলোয়ারসহ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী এবং ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান খাদিজা বেগম দাবি করেন, ‘সব অভিযোগ মিথ্যা।’

ক্রিসেন্ট হোল্ডিং লিমিটেড: ছরোয়ার জাহান নামে মিরপুরের এক বাসিন্দার অভিযোগ, মিরপুরে একটি প্রকল্প থেকে ২০০৬ সালে ফ্ল্যাট কিনে যথাসময়ে বুঝিয়ে দেননি এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। ফ্ল্যাটের জন্য তিনি এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে নয় লাখ টাকা পরিশোধও করেছেন। এ অভিযোগে তিনি আদালতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেছেন।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুন নবী বলেন, ‘ছরোয়ার জাহান সময়মতো টাকা দেননি। তাঁর দেওয়া টাকা আমরা ফেরত দেব।’

রিহ্যাবের বক্তব্য: অভিযুক্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যালেন্স ও প্রাইম লাইফ ছাড়া বাকিগুলো রিহ্যাবের সদস্য। দেশে আবাসন ব্যবসা করার জন্য রিহ্যাবের সদস্য হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বিশ্বাসযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি বৃদ্ধির জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান এ সংস্থার সদস্য হয়। কিন্তু যারা সদস্য না হয়ে আবাসন ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না রিহ্যাব।

অপর দিকে সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেও আপস কিংবা সদস্যপদ বাতিল ছাড়া আর কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই রিহ্যাবের।

তবে রিহ্যাবের কাস্টমার সার্ভিস অ্যান্ড মিডিয়েশন কমিটির চেয়ারম্যান মমিন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অভিযোগের সমাধান করতে সমর্থ হই। বহিষ্কার করাও বড় ধরনের শাস্তি হিসেবে গণ্য। বহিষ্কারের কথা শুনলে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক স্বার্থেই সমাধানে এগিয়ে আসে।’

‘সদস্য নয় এমন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে ভুক্তভোগীরা কী করবে?’ প্রশ্ন করলে মমিন ইসলাম বলেন, ‘তাঁরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।’

Category: 1stpage, দেশের খবর, শীর্ষ সংবাদ

About the Author ()

Leave a Reply