• ৪ জ্যৈষ্ঠ ,১৪৩১,18 May ,2024
  • ব্রেকিং নিউজ : বাংলাদেশের রিকশাচিত্র পেল ইউনেস্কোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি

‘রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করব’

| মার্চ 17, 2015 | 0 Comments

mashrafiiউৎপল শুভ্র, মেলবোর্ন থেকে:

দুদিন পর বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে টস করতে নামবেন। সেই রোমাঞ্চ ছাপিয়ে কাল সারা দিন মাশরাফি বিন মুর্তজার মনে বেদনার ছায়া। অকালপ্রয়াত প্রিয় বন্ধু মানজারুল ইসলাম রানার মৃত্যুবার্ষিকীতে ব্যথাতুর মাশরাফির সঙ্গে কথা শুরু হলো এ দিয়েই-

আজ যে একটা বিশেষ দিন, এটা কি আপনার মনে আছে?
মাশরাফি: মনে থাকবে না মানে, সকালে উঠেই মনে হয়েছে এই দিনে রানা চলে গিয়েছিল। আমার সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল ও। টুরে একসঙ্গে ঘুমাতাম। ও আলো থাকলে ঘুমাতে পারত না। দরজার নিচে যে একটু ফাঁক থাকে, ওখান দিয়ে আলো আসত বলে টাওয়েল গুঁজে দিত। আমি আবার অন্ধকারে ঘুমাতে পারি না। ওকে তাই মারতাম। ও-ই তাই স্যাক্রিফাইস করত। বলত, তুই আগে ঘুমা, আমি পরে ঘুমাব, আমি অন্ধকার ছাড়া ঘুমাতে পারি না।
২০০৭ বিশ্বকাপে রানা মারা যাওয়ার পরদিনই ভারতের সঙ্গে ম্যাচ ছিল। এবার আরেকটি বিশ্বকাপে দুই দিন পর সেই ভারতের সঙ্গেই খেলা। অদ্ভুত না?
মাশরাফি: হ্যাঁ। কিছুটা তো অদ্ভুতই। একটু আগে এটাই ভাবছিলাম, আবার সেই ম্যাচ। আসলে এই দুনিয়াতে কাকতালীয়ভাবে অনেক কিছুই মিলে যায়। আমরা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জিতলে তো দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে খেলতে হতো। আমরা এখন ভারতের সঙ্গে খেলছি।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের আগে আপনি বলেছিলেন, এই মেলবোর্ন আপনার অনেক কিছু নিয়ে নিয়েছে… রক্ত, মাংস…এবার যেন কিছু ফিরিয়ে দেয়। এই কোয়ার্টার ফাইনাল আপনাকে আবার সেই মেলবোর্নেই নিয়ে এল! এবার কি মেলবোর্নের কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার পালা?
মাশরাফি: আসলে সব কথা বলে ফেলা ভালো না। মনেরটা মনেই থাক। পারলে তখন বলব। তবে এটা সত্যি যে, এই মেলবোর্নে আমি অনেক কষ্ট করেছি। অপারেশনের পর অপারেশন। অপারেশন তো অজ্ঞান করে করেছে। বুঝিনি। কিন্তু এরপর যে কষ্ট…হাঁটতে পারি না, সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করা…
মেলবোর্নে আপনি কবে প্রথম এসেছিলেন? ২০০৩ সালে?
মাশরাফি: হ্যাঁ। ২০০৩-এ প্রথম আসি মেলবোর্নে।
এরপর তো আরও অনেকবার। তবে এবারই প্রথম মেলবোর্নে খেললেন, তাই না?
মাশরাফি: হ্যাঁ, তবে এর আগে বসে বসে প্র্যাকটিস দেখেছি এমসিজিতে। অপারেশনের কিছুদিন পর ডাক্তার বলতেন, এবার তুমি একটু হাঁটতে পারো। সারা দিন বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগত না। বাবু ভাই (অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ইকরাম) অফিসে যাওয়ার পথে আমাকে এমসিজিতে নামিয়ে দিতেন।
কোন টিমের প্র্যাকটিস দেখেছেন?
মাশরাফি: ভারতের প্র্যাকটিস দেখেছি। অস্ট্রেলিয়ার প্র্যাকটিস দেখেছি।
এই বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত তো আপনার কাছে মেলবোর্ন মানেই ডেভিড ইয়াং, অপারেশন…মেলবোর্ন মানেই যন্ত্রণা…
মাশরাফি: মেলবোর্নে এই প্রথম আমি হাঁটছি। খেলছি (হাসি)। এর আগে যতবার এসেছি, তিন-চার দিন হাঁটার পরই বিছানা (হাসি)। আসলে এই প্রথম মেলবোর্ন ঘুরে দেখতে পারলাম। বাবু ভাই যদিও তখনো ঘুরে দেখিয়েছেন। এখানে বাবু ভাই-মতিন ভাইদের মতো মানুষ না পেলে আমার আর ক্রিকেট খেলা হতো না।
২০০৭ বিশ্বকাপে মন্টিগো বেতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন ‘ধরে দিবানি’ কথাটা আমাকেই বোধ হয় আপনি প্রথম বলেছিলেন। বলেছিলেন, যদি উইকেট একটু ভেজা থাকে আর আমরা বোলিং করি, ভারতকে ‘ধরে দিবানি’। ওটা দিয়েই হেডিং করেছিলাম। এখন তো ‘ধরে দিবানি’ বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হয়ে গেছে।
মাশরাফি: ওই সময় তো অত কিছু বুঝতাম না। মনে হয়েছিল, বলে ফেলেছি (হাসি)। তবে এখানে যে উইকেট দেখছি, তাতে এটা ভেজা থাকার কোনো চান্স নেই। এখানে মনে হয়, ৩০০ রানের উইকেটই থাকবে। তবে ওই বার আমি ভালো বোলিং করলেও আমরা সবাই মিলে ভালো খেলেছিলাম বলেই জিততে পেরেছিলাম। পুরো টিম পারফরম্যান্স ছিল। এখানেও আমাদের টিম একসঙ্গে ভালো খেললে সুযোগ থাকবে। ওদের যে দল, তাতে আমরা এক-দুজন ভালো খেললে পারব না।
বাংলাদেশের প্রায় সব বড় জয়েই আপনার ওপেনিং স্পেলের একটা বড় ভূমিকা ছিল। সবাই তাই আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে। এটা কি চাপ না প্রেরণা?
মাশরাফি: মানুষ আমার কাছ থেকে আশা করে, এটাকে আমি সব সময় প্রেরণাই মনে করি। আর এখন এসে চাপটাপ নিয়ে একদমই ভাবি না। আমার জীবনে যা গেছে, তাতে এটা আর এমন কী চাপ! আমি যে এখনো ক্রিকেট খেলছি, সেটাই তো খেলার কথা না। এ জন্যই সব সময় ভাবি, আরও বেশি কিছু দিতে পারি কি না।
ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে কোন জিনিসটা নির্ধারক হবে বলে আপনার ধারণা?
মাশরাফি: আমাদের বোলিং।
তার মানে ব্যাটিংয়ের ওপর পুরো আস্থা আছে আপনার?
মাশরাফি: হ্যাঁ, কারণ ব্যাটসম্যানরা সবাই ফর্মে আছে। এই ম্যাচে কী হবে, সেটি পরের কথা। তবে এই বিশ্বকাপে যদি দেখেন দক্ষিণ আফ্রিকান বোলাররাও সংগ্রাম করছে, ভারতীয় বোলাররা এখনো সত্যিকার চ্যালেঞ্জে পড়েনি। অস্ট্রেলিয়ারও মিচেল স্টার্ক ছাড়া আর কেউ এমন বিরাট কিছু করেনি। বিশ্বের সেরা বোলিং অ্যাটাক বললে আপনি দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের কথা বলবেন। নিউজিল্যান্ড নিজেদের মাঠে খেলেছে বলে ভালো করেছে, তার পরও আমাদের কাছেই ওদের বোলাররা মার খেয়েছে। এখানে ইউএই পর্যন্ত ২৫০ রান করে ফেলছে। এর কারণ হচ্ছে, এখানে ট্রু উইকেট, বল উঁচু-নিচু হয় না। ব্যাটসম্যানদের বিশ্বাস থাকে যে, বল ব্যাটেই লাগবে। এখানে তাই বোলিংটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ এত ভালো বলে এই ম্যাচে তো সেটি আরও বেশি, তাই না?
মাশরাফি: বাংলাদেশে অনেকে মনে করছে ভারতের বিপক্ষে পড়েছি বলে আমরা লাকি। আবার আনলাকিও মনে করছে অনেকে। আমি বলব, সমান সমান। এই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার পরই ভারত সবচেয়ে ভালো খেলছে। ভারতের এই ব্যাটিংয়ের বিপক্ষে বোলিং করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জটা নিয়ে যদি আমরা জিততে পারি, ম্যাচটা খুব এক্সাইটিং হবে।
আপনি বলেছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালে পছন্দের প্রতিপক্ষ বলে কিছু নেই। তার পরও যদি সুযোগ থাকত, তাহলে কোন দলকে বেছে নিতেন?
মাশরাফি: সত্যি বলছি, কোনো পছন্দই নেই। আমি খুব করে চেয়েছিলাম যেন নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জিতি। জিতলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেতাম। সবচেয়ে বড় কথা, সবাই ভাবত আমরা অনেক বড় টিম। নকআউট ম্যাচে চাপ আছেই। সব দলই চিন্তা করবে, হেরে গেলেই বিদায়। আমরা যদি নিজেদের আট নম্বর দল ধরি, একমাত্র আমাদেরই এ নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কারণ, আমাদের হারানোর কিছুই নেই। বাংলাদেশের মানুষ তো আশা করেছেই, কিন্তু এই বিশ্বকাপ নিয়ে এত যে কথা শুনেছেন, কাউকে কি বলতে শুনেছেন বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে পারবে? কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যাওয়ার পর বলা হচ্ছে, ওরা কি এই চাপ নিতে পারবে? আমাদের ওপর কিসের চাপ, চাপ তো থাকবে অন্য দলের ওপর।
আপনার কি কখনো মনে হয় বাংলাদেশের মানুষ বাস্তবতাটা না বুঝে একটু বেশি আশা করে ফেলে?
মাশরাফি: এমন মনে হতে পারে। তবে এতে আমাদের পারফর্ম করতে সুবিধা হয়। আমরা তো বাংলাদেশের মানুষকে তেমন কিছুই দিতে পারিনি। যদি চিন্তা করে দেখেন, আমরা গত ১৫ বছর একঘেয়ে ক্রিকেট খেলে গেছি। কখনো হয়তো জিতেছি। আমি সব সময়ই বলি, বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রতিটি জয়ই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আমরা খুব বাজে খেলে হেরেছি। তার পরও বাংলাদেশের মানুষ আমাদের দিনের পর দিন সমর্থন করে গেছে। খারাপ খেললে গালি দেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দিনের পর দিন আমাদের যেভাবে সমর্থন দিয়েছে, এটা অসাধারণ। না হলে এই খেলাটায় যে এত মধু আছে, এত আনন্দ আছে, এর কিছুই আমরা পেতাম না।
ভারতীয় দলে তো অনেক তারকা। তার পরও যদি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে একজনের কথা বলতে বলি…
মাশরাফি: বিরাট কোহলি।
কেন?
মাশরাফি: একটু আগে আপনিই বলছিলেন না, ভারতের যে-ই দাঁড়িয়ে যাবে, সে-ই ম্যাচ বের করে নিয়ে যেতে পারবে। ধাওয়ান আছে, রোহিত শর্মা ওয়ানডেতে ২৫০-এর বেশি রান করেছে। রায়না গত ম্যাচে এক শ মারল। ধোনি তো অহরহ করে আসছে। এমনকি রাহানেও দুর্দান্ত ক্রিকেটার। তার পরও কোহলির কথা আলাদা করে বলব, কারণ ও এমন একজন ব্যাটসম্যান, যে ম্যাচ শেষ করে দিয়ে বেরোবে। ধোনিও তা করে, তবে ও যেখানে খেলে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু কোহলি তিন-চারে নেমেও শেষ পর্যন্ত খেলে আসে। এটাও একটা-দুইটা বা পাঁচটা-ছয়টা ম্যাচ না, অসংখ্য ম্যাচে এমন করেছে। ওর উইকেটটা তাই তাড়াতাড়ি নিতে হবে।
শেষ প্রশ্ন, ‘ধরে দিবানি’ ঘোষণা দেবেন এবার?
মাশরাফি: না, ‘ধরে দিবানি’ বলব না। তবে একটা প্রমিজ করতে পারি, আমরা আমাদের রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করব। এত দূর যখন এসেছি, সহজে ছাড়ব না। তবে হ্যাঁ, খেলায় কিছু বলা যায় না। আমরা খুব বাজেভাবেও হারতে পারি। আবার খুব ভালোভাবে জিততেও পারি। তবে একটা নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমরা সবাই নিজেদের উজাড় করে দেব।//প্রথম আলো

Category: 1stpage, Scroll_Head_Line, স্পোর্টস

About the Author ()

Leave a Reply