কোচিংবাণিজ্য: সরকারি হুশিয়ারিতেও হুশ নেই
সাখাওয়াত হোসেন কোচিংবাণিজ্যে জড়িত এমপিওভুক্ত শিক্ষকের এমপিও স্থগিত করাসহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে আবারো নতুন করে হুশিয়ারি দেয়া হলেও কারোরই তাতে গা নেই। বরং বেপরোয়া শিক্ষকদের অনেকে এটিকে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ‘ফাঁকা বুলি’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন। কেউ কেউ আবার এসব হুমকি-ধমকিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ‘চাঁদাবাজির’ নতুন কৌশল বলে ধরে নিয়েছেন। তাই অনেকেই তাদের ‘ম্যানেজ মিডিয়াকে’ খুঁজে পেতে এরই মধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছেন।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, কোচিংবাণিজ্য বন্ধে প্রায় চার বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা নীতিমালা অনুসরণ করতে ৪ মে মাউশি থেকে চিঠি পাঠানোর পর কোচিংবাজ শিক্ষকরা কিছুটা তটস্থ হলেও চবি্বশ ঘণ্টা পার না হতেই তা ভোজবাজির মতো মিইয়ে গেছে। বরং ষাণ্মাসিক পরীক্ষাকে সামনে রেখে এরই মধ্যে রাজধানীর অনেক নামিদামি স্কুলের দাপুটে শিক্ষক তাদের কোচিং সেন্টারের নতুন শাখা খুলেছেন। কেউ আবার ছোট পরিসর ছেড়ে বৃহৎ পরিসরে আস্তানা গেড়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক স্কুল ক্যাম্পাসেই চড়া ফি নিয়ে কোচিং করাচ্ছেন। মাউশির চিঠি পাওয়ার পরও বিপুলসংখ্যক শিক্ষক ক্লাসের শিক্ষার্থীদের তার নিজের কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন- এ অভিযোগ এখনো ভূরিভূরি।
তবে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের দাবি, স্কুল শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য বন্ধে গত ৪ মে মাউশির চিঠি পাওয়ার পর এ ব্যাপারে তারা কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। কোচিংবাণিজ্যে জড়িত স্কুলের ছয় শিক্ষককে গ্রীষ্মের ছুটির আগে ‘শোকজ’ দেয়া হয়েছে।
অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম যায়যায়দিনকে বলেন, ‘কোচিংবাণিজ্যে স্কুলের আরো কোনো শিক্ষক জড়িত আছে কিনা তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ এ ব্যাপারে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে ভিকারুননেসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোছা. সুফিয়া খাতুন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘নতুন স্কেলে বেতন বৃদ্ধির পর কোচিংবাজ শিক্ষকদের এ পথ থেকে সরে ক্লাসে ফিরে আসার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় কারো বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশন’ নিতে পারিনি।’ কোচিংবাণিজ্য বন্ধ করে শিক্ষার মান ফিরিয়ে আনতে সরকারের আরো কঠোর ভূমিকা গ্রহণ জরুরি বলে মন্তব্য করেন সুফিয়া খাতুন।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভিকারুননেসা নূন স্কুলের অন্তত ৪৫ জন শিক্ষক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন সিদ্বেশ্বরী এলাকার বিভিন্ন অলিগলিতে কোচিংবাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন। এসব কোচিং সেন্টারের প্রতিটিতেই ৪০ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
এদিকে এ ব্যাপারে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষকরা আরো এক ধাপ এগিয়ে রয়েছেন। শাহজাহানপুরসহ রাজধানীর অন্তত ২০টি স্পটে তাদের অর্ধশতাধিক কোচিং সেন্টার রয়েছে। শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় কোনো কোনো সেন্টারে মাইক্রোফোন লাগিয়েও কোচিং করানো হচ্ছে।
এসব কোচিং সেন্টারে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সংখ্যাধিক্যের কারণে সেখানেও তেমন পড়াশোনা হয় না। তারপরও শুধুমাত্র শিক্ষকদের মন রক্ষার্থে তারা সেখানে কোচিং করতে হচ্ছে। ক্লাস টিচারের কোচিং সেন্টারে না পড়লে নানা ধরনের হয়রানির মুখে পড়তে হয় বলে অভিযোগ করেন অভিভাবকরা।
দফায় দফায় হুমকি-ধমকি দেয়া হলেও কোচিংবাণিজ্য কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না- তা জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সোহরাব হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, ‘শুধু স্কুল শিক্ষকদের কোচিং নয়, আমরা সব ধরনের কোচিং সেন্টার বন্ধ করার চেষ্টা করছি। এ জন্য শিক্ষা আইনের খসড়া করা হয়েছে। তাতে আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইন পাস হলে সব ধরনের কোচিং বন্ধ হয়ে যাবে।’
সোহরাব হোসেন বলেন, আইন না থাকায় কোচিংবাণিজ্য বন্ধের নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। তবে আইন প্রণয়ন হলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যাবে।
জানা গেছে, শিক্ষা আইন-২০১৬-এর খসড়ার ৫৪ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে- ‘সরকার প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এই ধারা লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদ- বা ৬ মাসের জেল বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন।
এ খসড়াটি জনমত যাচাইয়ের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তিনবার দেয়া হয়েছে। এটি চূড়ান্ত হলে পরবর্তীতে আইন মন্ত্রণালয় ও সংসদে পাঠানো হবে।
তবে এসব ধাপ পার হয়ে এ আইন পাস হতে আরো কত সময় লাগবে সে ব্যাপারে খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারাও কিছু জানাতে পারেননি।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সোহরাব হোসেন বলেন, ‘এ আইন পাস হতে ছয় মাসও লাগতে পারে; আবার বছরও পেরিয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাবে না।’
এদিকে কোচিংবাণিজ্য বন্ধে চার বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা নীতিমালার নানা হুমকি-ধমকি যে শুধুমাত্র ‘কাগজ-কলমেই’ সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে- তা একটু খতিয়ে দেখলেই পরিষ্কার হওয়া গেছে। যদিও মাউশির ডিজি ফাহিমা খাতুন এ বিষয়টি অস্বীকার করেন।
তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, কোচিংবাণিজ্যে জড়িত বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে বদলি করা হয়েছে। অনেককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে কোচিংবাজ অনেক শিক্ষক সে পথ থেকে সরে এসেছেন।
তবে এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ২০১২ সালে শিক্ষানীতি জারির পর থেকে এখন পর্যন্ত একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি ও পাঠ্যদানের অনুমতি বাতিল করা হয়নি। এমনকি কোচিংবাজ একজন শিক্ষকের এমপিও বাতিল করারও কোনো নজির নেই।
এদিকে ২০১৩ সালে ঢাকঢোল পিটিয়ে কোচিংবাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের তালিকা তৈরির উদ্যোগের পর কোনো শিক্ষকের শাস্তি না হওয়ার রহস্য খুঁজতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কোচিংবাণিজ্যে অভিযুক্ত শিক্ষকদের হুমকি-ধমকি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। স্কুল শিক্ষকদের কোচিং সেন্টার থেকে এ চক্র নিয়মিত মাসোহারা আদায় করছে।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, কোচিংবাণিজ্য বন্ধের উদ্যোগে উল্টো শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেননা মাউশির অধীন আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন প্রশাসনে কোচিংবাজ শিক্ষককে যে উৎকোচ দিতে হয়েছে তারা তা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পুষিয়ে নিচ্ছেন।
কোচিংবাণিজ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ওই শিক্ষক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আটঘাট না বেঁধে ফাঁকা হুমকি-ধমকি দিয়ে শিক্ষাঙ্গনে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি তৈরির কোনো মানে হয় না।’ তার ভাষ্য, কোচিংবাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কেউ না থাকলেও তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের লোকের অভাব নেই।
এদিকে অভিভাবক ফোরামের একজন নেতা বলেন, কোচিংবাণিজ্য বন্ধের আগে শ্রেণিকক্ষের লেখাপড়ার মান উন্নত করা জরুরি। যথাযথ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কোচিংবাজ শিক্ষকদের স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে শিক্ষার মান ভয়াবহভাবে ভেঙে পড়বে। কারণ শ্রেণিকক্ষে যেভাবে পড়াশোনা হয় তাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে পাস মার্ক জোগাড় করা কঠিন; অথচ সরকার সেদিকে নজর দিচ্ছে না- যোগ করেন ওই অভিভাবক নেতা।
Category: 1stpage, Scroll_Head_Line, স্টুডেন্ট কর্ণার