জেলা পরিষদেও ‘ফেনী স্টাইল’
দেশের খবর: জাতীয় সংসদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের পর এবার নির্দলীয় জেলা পরিষদেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের ধারা অব্যাহত আছে। ৬১ জেলার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা ভোটে বিজয়ী হওয়ার পথে। ৩০ জেলায় দলীয় সমর্থিত প্রার্থীর বাইরেও আওয়ামী লীগের নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। তবে দলের নেতারা মনে করছেন, বেশির ভাগ জেলায় দলীয় সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হবেন।
পার্বত্য তিন জেলা বাদে দেশের ৬১টি জেলায় ২৮ ডিসেম্বর জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার ধারা সৃষ্টি হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে তখন ১৫৪ আসনেই বিনা ভোটে সাংসদ নির্বাচিত হন। এরপর পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদেও একই ধারা অব্যাহত ছিল।
তবে এ ক্ষেত্রে ফেনী নজির সৃষ্টি করেছে। সেখানে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছাড়াও ১৫টি সাধারণ সদস্য ও পাঁচটি সংরক্ষিত নারী সদস্য পদের সবগুলোতেই প্রার্থীরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। এর আগে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও মেয়র, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে বিপুলসংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, যা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ‘ফেনী স্টাইল’ নামে পরিচিতি পায়।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত এই নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের অংশগ্রহণ নেই। তার ওপর সব দলের প্রতিনিধিত্বশীলও নয়। এ অবস্থায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন, ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার যে প্রবণতা ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদের নির্বাচন থেকে শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত থাকা গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়। এ বিষয়টি নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন ব্যবস্থার বিষয় নয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিষয়। রাজনৈতিক এ সংস্কৃতি ভালো ইঙ্গিত বহন করে না।’
পরোক্ষ পদ্ধতির জেলা পরিষদ নির্বাচনে সরকার-সমর্থকদের বাইরে কারও জয়ের সম্ভাবনা নেই ভেবে অন্য বড় দলগুলো অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগের নেতারা শুরু থেকেই মনে করে আসছেন, দলের সমর্থন পাওয়া প্রার্থীরাই জয়ী হবেন। এ জন্য দলের সমর্থন পেতে ৬১ জেলায় ৭০০ নেতা আবেদন করেছিলেন।
গতকাল রোববার ছিল প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২২ জেলায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর বাইরে আর কেউ প্রার্থী হননি। ফলে তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। অর্থাৎ ৩৬ শতাংশ জেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোট হবে না। ৩৯ জেলায় একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগেরই একাধিক প্রার্থী। এর মধ্যে ৩০ জেলায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ৫০ জন দাঁড়িয়ে গেছেন।
এর মধ্যে পাবনায় জেলা পরিষদ নির্বাচন জমে উঠেছে। ওই জেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ভায়রা সাইদুল হক। তিনি এর আগে জেলা পরিষদের প্রশাসক ছিলেন। তাঁকে বাদ দিয়ে এবার দলের সমর্থন পেয়েছেন মোহাম্মদ রেজাউল রহিম। এই জেলায় ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের মেয়ে মাহজেবিন শিরিন বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর স্বামী আবুল কালাম আজাদ ঈশ্বরদী পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, মাহজাবিনের দাঁড়ানোর ব্যাপারে মন্ত্রীর সায় ছিল না। স্বামীর সমর্থন নিয়েই তিনি প্রার্থী হয়েছেন। আর চাঁদপুর জেলায় দলের সমর্থন পাওয়া আবু ওসমান চৌধুরী স্থানীয় ভোটার না হওয়ায় প্রার্থী হতে পারেননি। ওই জেলায় আওয়ামী লীগেরই চারজন প্রার্থী হয়েছেন এবং দল কাউকে সমর্থন না দিয়ে উন্মুক্ত রেখেছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, দলের সমর্থন পাওয়া ব্যক্তিরাই বেশির ভাগ জেলায় জয়ী হবেন, এটা প্রায় নিশ্চিত। এরপরও কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। বসানোর জন্যও কঠোর কোনো অবস্থানে যাবে না দল। তবে যেসব স্থানে একাধিক প্রার্থী থাকার কারণে দলের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে বলে মনে হয়, সেগুলোতে বিদ্রোহীদের বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্যে জামালপুরে দলের সমর্থিত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করার পর ফারুক চৌধুরীর লোকজন সহিংস হয়ে ওঠেন।
আওয়ামী লীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থী বেশি হলে টাকার মাধ্যমে ভোট কেনার একটা প্রবণতা শুরু হতে পারে। জেলা পরিষদে ভোটার হচ্ছেন ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। গত কয়েক বছরে স্থানীয় সরকারের এই স্তরগুলোতে প্রার্থী হওয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া পর্যন্ত বিপুল অর্থ ব্যবহারের অভিযোগ ছিল। এসব প্রতিনিধির অনেকেই হয়তো জেলা পরিষদের নির্বাচনে কিছুটা হলেও অর্থের পেছনে ছুটতে পারেন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, গতকাল রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে ধানমন্ডি কার্যালয়ে বৈঠক করেন। সেখানে কয়েকটি জেলায় দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া নেতাদের ফোন করে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেন ওবায়দুল কাদের।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকারের প্রার্থী মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ও দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, এটি নির্দলীয় নির্বাচন। এরপরও দল একজনকে সমর্থন দিয়েছে। সবাইকে দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য কাজ করা উচিত। কিন্তু দলীয় প্রার্থীর বাইরে কেউ যদি নিজেকে অধিক যোগ্য মনে করেন, তাহলে দাঁড়াতে বাধা নেই। কেউ নিজ যোগ্যতায় জয়ী হয়ে আসতে পারলে দলের কোনো আপত্তি নেই।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন যাঁরা: ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ গুরুত্বপূর্ণ ২২টি জেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে। এসব জেলা পরিষদ অত্যন্ত সম্পদশালী বলে পরিচিত। সরকারি বরাদ্দের বাইরেও এসব জেলার নিজস্ব সম্পদ ও আয়ের উৎস রয়েছে। যে ২২ জেলায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হওয়ার পথে সেগুলো হচ্ছে ঢাকায় মাহবুবুর রহমান, চট্টগ্রামে এম এ সালাম, গাজীপুরে আখতারুজ্জামান, মুন্সিগঞ্জে মহিউদ্দীন আহমেদ, নারায়ণগঞ্জে আনোয়ার হোসেন, নাটোরে সাজেদুর রহমান খান, সিরাজগঞ্জে আবদুল লতিফ বিশ্বাস, ঠাকুরগাঁওয়ে সাদেক কোরাইশী, জয়পুরহাটে আরিফুর রহমান, নেত্রকোনায় প্রশান্ত কুমার রায়, যশোরে শাহ হাদিউজ্জামান, বাগেরহাটে শেখ কামরুজ্জামান, ঝালকাঠিতে সরদার শাহ আলম, ভোলায় আবদুল মমিন, কুষ্টিয়ায় রবিউল ইসলাম, ফরিদপুরে লোকমান হোসেন মৃধা, হবিগঞ্জে মুশফিক হোসেন চৌধুরী, কিশোরগঞ্জে মো. জিল্লুর রহমান, ফেনীতে আজিজ আহমেদ চৌধুরী, নওগাঁয় এ কে এম ফজলে রাব্বী, টাঙ্গাইলে ফজলুর রহমান খান ফারুক ও দিনাজপুরে আজিজুল ইমাম চৌধুরী।//প্রথম আলো
Category: 1stpage, Scroll_Head_Line, দেশের খবর, শীর্ষ সংবাদ