• ৯ অগ্রহায়ণ ,১৪৩১,23 Nov ,2024
  • ব্রেকিং নিউজ : বাংলাদেশের রিকশাচিত্র পেল ইউনেস্কোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি

চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা

| এপ্রিল 14, 2013 | 0 Comments

দেশের খবর: ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
বাঙালির কণ্ঠে এভাবেই ধ্বনিত হয় তার চেতনা, চরিত্র এবং আকাঙ্ক্ষার সারাৎসার। অগণন ঝড়-ঝাপটার পরও বাঙালির মৌল প্রেরণা থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছেদ ঘটেনি। বর্ষবরণ বাঙালি সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত এক সর্বজনীন প্রাণের উৎসব। বাংলার কৃষক-বণিকসহ সব ধরনের পেশা-ধর্ম-বর্ণের মানুষ একাত্ম হওয়ার এই উৎসবে কালে কালে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা। বর্ষবরণ উপলক্ষে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এই নতুন মাত্রার উজ্জ্বল সংযোজন।
বৃহৎ বাংলার ভূমি সন্তানেরাই বাঙালি আর সংস্কৃতি মাত্রই চলমান। মানব প্রজাতির অর্জিত ব্যবহার বা অভ্যাস অথবা অনুশীলনজাত উৎকর্ষই হয় সমকালীন সংস্কৃতির রূপ। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় সমকালীনতা এবং চলনশীল বাঙালি সংস্কৃতির রূপটি বেশ সুস্পষ্টভাবে ধরা দেয়। আত্মবিকাশের ধারায় বাঙালির মিলন-বিরোধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত আছে, বিকার-প্রতিকারের প্রয়াস রয়েছে, উত্থান-পতন, স্বাধীনতা ও পরাধীনতা আছে। উৎসব-পার্বণ-বিনোদনে বাঙালির মনোভূমি কর্ষণ করছে সযত্নে। সে এই মাটিকে ভালোবেসেছে, এ জীবনকে সত্য বলে জেনেছে। তাই সে দেহতাত্ত্বিক, তাই সে প্রাণবাদী, তাই সে যোগী ও অমরত্বের পিপাসু। বৌদ্ধ আমলে তার সাধনা ছিল নির্বাণের নয় বাঁচার; কেবল মাটি আঁকড়ে বেঁচে থাকার। মন ভোলানো ভুবনের বনে বনে, ছায়ায় ছায়ায়, জলে-ডাঙায়, প্রশান্ত জীবনকেই প্রাধান্য দিয়েছে বাঙালি। পাল আমলের গীতে মনে হয়, যোগে নয়, ভোগেও নয়, মর্ত্যকে ভালোবেসে দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যেই যেন সে বাঁচতে চেয়েছে। সেন আমলের ব্রাহ্মণ্যবাদিতার প্রাবল্যে গীতা-স্মৃতি-উপনিষদের মতো সে মুখে গ্রহণ করলেও মনে মানেনি। কেননা, সে ধার করে বটে, কিন্তু জীবনের অনুকূল না হলে তা অনুকরণ বা অনুসরণ করে না। ওহাবি-ফরায়েজি আন্দোলনের পরও এখানে শরিয়তে ইসলাম তেমন আমল পায়নি। তখন পার্থিব জীবনের স্বস্তি ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য কল্পিত হয়েছিল পাঁচ গাজি ও পাঁচ পীর। নিবেদিত চিত্তের ভক্তি লুটেছে খানকা, অর্ঘ্য পেয়েছে দরগাহ আর শিরনি পেয়েছে সুফিদের লোকায়ত ভাব। বাঙালি এই ঐতিহ্য আজও হারায়নি। বাঙালির শৌর্য-বীর্য হানাহানির জন্য নয়, তার প্রয়াস ও লক্ষ্য নিজের মতো করে স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকার। আনন্দে-আমোদে থাকার প্রবণতা, বাঙালির প্রাণের সঙ্গে মিশে যাওয়া বৈশিষ্ট্য। তাই ধর্মীয় বলয়ের বাইরে যেকোনো ঐতিহ্যবাহী পালা- পার্বণে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বর্ষবরণ সম্ভবত সমসাময়িক কালের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এই বর্ষবরণও সব সময় সবকালে একই রূপে আবর্তিত নয়; বরং নতুন সময়ে নতুন চিন্তা ও মননের সুদক্ষ প্রয়োগ দেখা যায়। মঙ্গল শোভাযাত্রায়ও প্রতিনিয়ত সংযোজন হচ্ছে নতুন চেতনার ভঙ্গিসমূহ।
বাঙালির শিল্পচর্চায় আকাঙ্ক্ষা আর সীমাবদ্ধতার মনোভূমিতে শিল্পীরা নতুন পথের সন্ধান খুঁজে বেড়ান। সময়ের প্রয়োজনেই শিল্পের সম্ভাবনা বিস্তৃত হয়। বাঙালির স্বকীয় জীবনধারার প্রতিটি ক্ষেত্রে শিল্পমগ্নতা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। প্রাচীনকাল থেকেই উৎসবপ্রবণ জাতি হিসেবে বাঙালি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে লক্ষণীয়।
শিল্পচর্চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভূমিকা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নববর্ষ উদ্যাপন বাঙালির সুপ্ত চাহিদার দীর্ঘ অপেক্ষার প্রতিফলন। চারুকলা থেকেই বাংলা নববর্ষের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ সর্বজনীন হয়ে উঠেছে; এই শৈল্পিক উৎসব নাগরিক জীবনে প্রাণসঞ্চার করলেও মূলত বাংলার মাটির গন্ধকে লালন করে চলেছে এবং ঐতিহ্যের পাখনায় নতুন নতুন পালক যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যশোরে চারুপীঠের উদ্যোগে প্রথম এই শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে; আর ঢাকায় চারুকলা অনুষদের কিছু শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে প্রথম এই আয়োজন হয়। কিন্তু দ্বিতীয়বার উৎসবের সময় শিল্পী ইমদাদ হোসেন এর নামকরণ করেন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। যেকোনো অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করে নতুন একটি বছর শুরুর উদ্দেশ্যেই এই অভিযাত্রা। নব্বইয়ে জাতির সংকটকালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী তাদের প্রতিবাদের ভাষায় সম্পৃক্ত হয়েছিল; আজ এত বছর পর এসে নতুন প্রজন্ম খুব সহজেই বুঝতে পারছে এর মর্মকথা আর উদ্দেশ্য। সাম্প্রদায়িক ভাবনা থেকে বেরিয়ে যে স্বদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, সেখানে বাঙালির সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অপশক্তির কালো ছায়া আমাদের আঁকড়ে রয়েছে এখনো। মঙ্গলের চেতনা জাতি ধারণ করে সাংস্কৃতিক-বলয় নির্মাণের স্বপ্ন এঁকে চলেছে।
বাঙালির জন্য এমন এক উৎসব প্রয়োজন, যা জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সবার নিজস্ব বলে মনে হবে এবং পুরো জাতি একাত্ম হয়ে উদ্যাপন করবে। আর সে কারণেই বাংলা নববর্ষ নির্ধারণ করা সহজ হয়েছে। এই উৎসবে শ্রেণী-বর্ণ-ধর্মনির্বিশেষে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বসিত অংশগ্রহণ উদ্দীপ্ত করে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রধান যে মোটিভ ব্যবহূত হয় তা সম্পূর্ণভাবেই এ দেশের লোকজ ঐতিহ্য থেকে সংগৃহীত। বাংলার আবহমানকাল থেকে কাঠের-মাটির-শোলার মাধ্যমে তৈরি বাঘ, হাতি, ঘোড়া, পাখি, প্যাঁচা, কুমির, টেপা পুতুল, গরুর গাড়ি, পালকি, নৌকা, পাখা, ঝালর—এসব মোটিভকে প্রাধান্য দিয়ে এই শোভাযাত্রায় মূল প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয় প্রতিবছর। বাংলাদেশের এক অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য অঞ্চলের পরিচয় করিয়ে দেওয়ারও একটি উদ্যোগ থাকে এই মোটিভ নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দেশপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শিল্পী কামরুল হাসানের লোকজ শিল্পের প্রতি মমত্ববোধ তাড়িত করে শিল্পীদের সব সময়। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসংস্থার (বিসিক) আয়োজনে বৈশাখী মেলা, লোকজ শিল্পের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বংশপরম্পরায় বাংলার লোকজ শিল্পীদের কারুকর্ম এবং দেশীয় সংস্কৃতিতে তাঁদের অবদানকে সম্মান দেখানোর জন্যও এই মোটিভ নির্দিষ্ট করা একটি লক্ষ্য। আবার দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের যোগসূত্র তৈরি করারও একটি আকাঙ্ক্ষা থাকে; এই নববর্ষ উদ্যাপনের প্রস্তুতিতে ঢাকা চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আশাবাদী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিল্পশিক্ষার্থীরা এই অনুষদের অগ্রজ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এই বর্ষবরণ আয়োজনে অংশগ্রহণ করে। নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য এই উৎসব উদ্দীপ্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্ম দেয় যা শিল্পাচার্যের স্বপ্ন এবং চারুকলার প্রধান প্রাণশক্তি। দেশের যেকোনো সংকটে এই নতুন প্রজন্ম আশা-জাগানিয়া হয়ে উঠবে। এ ছাড়া মঙ্গল শোভাযাত্রায় সময়ের প্রয়োজনে দেশের রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিষয়ভিত্তিক মোটিভও নির্মিত হয়, যা বক্তব্যসমৃদ্ধ অবস্থান তৈরি করে। এভাবেই শিল্পীদের সচেতন শৈল্পিক অবস্থানের চেষ্টা দেখা যায় এই বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের ক্ষেত্রে। ২০০০ সালের পর ক্ষমতাসীন জোট সরকারের আমলে একবার ঢাকা চারুকলা বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছিল এই বর্ষবরণ উদ্যাপনের ক্ষেত্রে। অনুষদের শিক্ষার্থীদের পরিবর্তে বাইরের লোকজন দিয়ে এই উৎসব করা হয়েছিল, যা সাধারণ মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিল সম্পূর্ণভাবে। এই সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল একটি চেতনা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। পরবর্তী সময়ে এই উৎসবের ধরন একটি দৃঢ় ভিত পেয়েছে; শিল্পীদের সিদ্ধান্ত এই বর্ষবরণ উৎসব বাণিজ্যিকীকরণ না করা; স্বকীয়তা বজায় রেখে দেশব্যাপী বিস্তৃত করা। এ ক্ষেত্রে শিল্পশিক্ষার্থীদের উদ্যোগে সম্পূর্ণ অর্থ সংগৃহীত হয় বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম, মুখোশ, সরাচিত্র আর কারুশিল্পের নানা উপাদান বিক্রয়ের মাধ্যমে। একটি উৎসবকে কেন্দ্র করে শিল্পশিক্ষার্থীদের আয়োজন আর ক্রমান্বয়ে তা জাতীয় উৎসবে পরিণত হওয়া—এই উপলব্ধি একজন শিল্পীর মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ।
চিন্তাজগতে বাঙালির বিদ্রোহের ইতিহাস সুপ্রাচীন। বাস্তবে তাকে পরাস্ত করা গেছে। ইতিহাসের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে কিন্তু তার মেধা-মনন কখনোই আত্মসমর্পণ করেনি। নীহাররঞ্জন রায় কথিত বেতস লতার চরিত্রটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। ঝড়ের তাণ্ডবে নুয়ে পড়া বাঙালি পরমুহূর্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। চেতনা ও ঐতিহ্যের জায়গায় তার সুস্পষ্ট অবস্থান ইতিহাস থেকে তাকে মুছে দিতে পারেনি। স্বকীয় বোধ-বুদ্ধির প্রয়োগে তত্ত্ব-তথ্যকে, প্রতিবেশ ও পরিস্থিতিকে নিজের জীবন ও জীবিকার অনুকূল ও উপযোগী করে তোলার সাধনাতেই বাঙালি নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে। এ জন্যই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ বাঙালির মানস সন্তান হলেও নেতৃত্বে থাকেনি বাঙালির। রাজনীতির তত্ত্বের দিকটিই আকৃষ্ট করেছে বেশি, বাস্তব প্রয়োজনে সে অবহেলাপরায়ণ। কারণ, তাতে বাহুবল, ক্রুরতা ও হিংস্রতা প্রয়োজন। এই শান্তিপ্রিয়তা তার জল-ভূগোল-আবহাওয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষির ভিত্তিতে দাঁড়ানো বাঙালির অর্থনীতির বনিয়াদ। কৃষকের চরিত্রটিও তাই প্রধান দিক। উৎসবে তার যত আগ্রহ, বিলিয়ে দেওয়ায় তার যত আনন্দ, আন্তরিক আপ্যায়নে তার যত প্রস্তুতি ততটা আর কোথাও পাওয়া যায় কি না সন্দেহ আছে। সারা বাংলায় এই বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে অনেক কিছু সামনে চলে আসে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় যত শিল্পীর যৌথ শ্রম (বিনা পারিশ্রমিক)—এই বাঙালি চরিত্রের অংশ। তবে শুধু চেতনাগত দিকেই নয়, সময়ের প্রয়োজনে বাঙালির সরাসরি বিদ্রোহী হয়ে ওঠারও রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত। কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ক্ষুুদিরাম, সূর্য সেন, প্রীতিলতা, তিতুমীর, ফকির, সন্ন্যাসীদের ফুঁসে ওঠা এবং নিজস্ব ভূখণ্ডের জন্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জীবনের নতুন অধ্যায়।
বৈশাখী আয়োজনগুলো বাঙালির সর্বকালীন-সর্বজনীন উৎসব। যখন বাঙালি তার ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসেছে; মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ধর্ম, তখনই রক্তাক্ত হয়েছে এখানকার মাটি। আর এখন বাঙালি আত্মস্থ হয়েছে। তার আত্ম-জিজ্ঞাসা প্রখর হয়েছে, সংহতি কামনা হয়েছে প্রবল। ঔপনিবেশিক শিক্ষা তাকে ভুলিয়ে দিতে পারেনি মাটির ঘ্রাণ, এই মাটি থেকেই ফুলের মতো ফুটে ওঠে শিল্পকলা আর কবিতার পঙিক্ত। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি জাতির আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নের সীমাকে বিস্তৃত আর দীর্ঘায়িত করে।
অনুলিখন

Category: 1stpage, দেশের খবর, প্রচ্ছদ

About the Author ()

Leave a Reply