অভিজাত এলাকায় বাঙ্গালীর হাজার বছরের ঐতিহ্য লুঙ্গি নিষিদ্ধ
দেশের খবর: ১৬ কোটি মানুষের এই দেশটিতে গুটি-কয়েক কথিত এলিট শ্রেণী ছাড়া বাকি সবার অন্যতম পোশাক লুঙ্গি। সেখানে বারিধারা এলাকায় বারিধারা সোসাইটির পক্ষ লুঙ্গি পরে চলাচল নিষিদ্ধ করার ঘোষণা এদেশের মাটি এবং মেহনতি মানুষের প্রতি প্রতি চরম অবজ্ঞা, বিদ্রুপ ও বিদ্রোহের নামান্তর। আমরা এর আগেও দেখেছি লুঙ্গি পরে যাওয়ার কারনে ফরহাদ মজহারকে সর্ব আমলে ক্রীমভোগীদের ঢাকা ক্লাবে ঢুকতে দেয়া হয়নি। অথচ গোটা বিশ্বময় কোথাও তাকে লুঙ্গি পরার কারনে বাধা দিতে দেখা যায়নি। সেদিন ফরহাদ মজহার কোটি কোটি সাধারণ মানুষের পোশাককে অপমান করায় সেখানে অবস্থান নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে ঢাকা ক্লাবের কথিত অভিজাতদের ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন।
হাফপ্যান্ট কিংবা অশোভণ-অর্ধনগ্ন পোশাক পরে মতলামি করলে ওদের আভিজাত্য যায় না। যত বিদ্রুপ এদেশের খেটে খাওয়া ও শোষিত=বঞ্চিত সাধারন মানুষের জীবন চর্চার প্রতি।
একটি স্বাধীন দেশে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে-পোশাক পরে, যে-পোশাক আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেই পোশাক পরার ক্ষেত্রে বাধানিষেধ জারি রাখার বিধান বহাল রাখার ঔপনিবেশিক ‘নিয়ম’ বা ঔদ্ধত্য কোন প্রতিষ্ঠানের থাকতে পারে কি না। ব্যক্তি, ক্লাব, প্রাইভেট প্রপার্টি, সংগঠন, সমিতি যাই বলি না কেন তারা কি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের বাইরে? সংবিধানের বিরোধী বা সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কোন ‘কোড’, ‘আইন’, বা ‘বিধান’ বহাল রাখতে পারে কি কেউ? যাঁরা সংবিধান বিশেষজ্ঞ তাঁরা আশা করি আমাদের পরামর্শ দেবেন।
আমরা দেখি যে সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশের ৩২ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।’ বাংলাদেশে কি এমন কোন আইন আছে যে ঢাকা ক্লাবে লুঙ্গি পরে যাওয়া যাবে না? কোন ক্লাব বা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান কি সংবিধান বা আইনের উর্র্ধ্বে? এমন কোন ‘কোড’ বানিয়ে তাকে ‘আইন’ বলে দাবি করতে কি তারা পারে যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক? কে কী পোশাক পরবেন সেটা ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ রক্ষার ক্ষেত্রে সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অন্যদিকে মৌলিক অধিকার অংশেরই অনুচ্ছেদ ৩৬ বলছে, ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস, ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত’ এমন কোন বাধানিষেধ বাংলাদেশে আছে কি না যাতে এই দেশের মানুষের পোশাক লুঙ্গি পরে কেউ ‘সর্বত্র চলাফেরা’ করতে পারবে না? লক্ষ্য করার বিষয় যে এখানে সুস্পষ্টভাবে ‘সর্বত্র চলাফেরা’ করার অধিকারের কথা বলা হয়েছে।’ এই প্রশ্ন শুধু ঢাকা ক্লাব নয় আরও অন্যান্য জায়গার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
‘ড্রেস কোড’ একান্তই কলোনিয়াল সংস্কৃতি, ভাষাটাও ঔপনিবেশিক। যে কোন ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ড্রেস কোডের পক্ষে যাঁরা বলছেন তাঁরা যুক্তি দিতে পারছেন না কেন লুঙ্গি, ধুতি ইত্যাদি সাধারণ মানুষের পোশাকের প্রতি তাদের এতো তীব্র ঘৃণা? অথচ ঘৃণাটা খুবই স্পষ্ট। ঢাকা ক্লাব গর্বের সঙ্গে দাবি করছে শুধু লুঙ্গি নয়, ধুতিও নিষিদ্ধ। ‘ড্রেস-কোডের নামে পরিষ্কারভাবে সাধারণ মানুষের পোশাকের প্রতি ঘৃণা চর্চা।
আমরা আজকেও দেখলাম বারিধারাতে শোষক এলিট শ্রেণীর এদেশের মেহনতি মানুষের পোশাককে অবমাননা করায় তরুণ প্রজন্ম লুঙ্গি মার্চ করছে।
আজ মনে পড়ে এদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ভাসানীর কথা। ভারত যখন ফারাক্কা বাধ দিয়ে বাংলাদেশকে মরুভুমি বানানোর পায়তারা চালায় তখনও তিনি ধমক দিয়ে উঠেছিলেন ‘খামোশ’ বলে।
আজকে বারিধারা কিংবা ঢাকা ক্লাবের অর্বাচিনরা কি তাকেও ঢুকতে দিত না। দেশীয় সংস্কৃতির এই অপমান দেখে তিনি যদি খামোশ দিয়ে ধমক দিয়ে উঠতেন তাহলে বাংলার জনতার আক্রোশে ঢাকা ক্লাব কিংবা অভিজাত বারিধারা মাটির সাথে মিশে যেত।
লুঙ্গি মার্চে পুলিশের বাধা
বারিধারা এলাকায় লুঙ্গি পরে চলাচল নিষিদ্ধের প্রতিবাদে ডাকা লুঙ্গি মার্চ আটকে দিয়েছে বনানী থানা পুলিশ।
বনানী খেলার মাঠ থেকে বারিধারা অভিমুখে লুঙ্গি পরে মার্চ করে যাওয়ার কথা থাকলেও সেখান থেকে তাদের সংঘবদ্ধ হয়ে বের হতে বাধা দেয় পুলিশ।
রাজধানীর বারিধারায় লুঙ্গি পরে চলাচলে নিষেধ করায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঘোষণা দেয় রাজধানীর বারিধারা, গুলশান বনানীসহ রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকার তরুণ-তরুণীরা।
বারিধারা এলাকার বাসিন্দাদের সামাজিক সংগঠন বারিধারা সোসাইটির পক্ষ থেকে সেখানে এই নিয়ম জারি করা হয়েছে।
পরে পুলিশ লুঙ্গি মার্চে অংশ নেয়া লোকদের যার যার মতো মাঠ ত্যাগের অনুরোধ জানিয়ে ছেড়ে দেয়। তারা সেখান থেকে বের হয়ে আবার একসঙ্গে বারিধারার দিকে যেতে চাইলে বনানী মাঠের অদূরে বারিধারার দিকে যাওয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয় পুলিশ। সেখানে পৌঁছে তারা ‘লুঙ্গি’ ‘লুঙ্গি’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। খবর আরটিএনএন।
এ সময় বারিধারার বাসিন্দা রুবাইয়া আহমাদ নামের এক মহিলা পুলিশের কাছে দাবি করেন, এরা সবাই আমার বাসায় যাবে, এরা আমার মেহমান। তাদের বাধা দেয়ার কোনো দরকার নেই। সে সময় রুবাইয়া আহমাদ ও পুলিশের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা হয়। রুবাইয়া আহমাদ পশুপ্রেমীদের সংগঠন অভয়ারন্য’র প্রধান নির্বাহী।
পুলিশ সেখানে তাদের প্রায় এক ঘণ্টা আটকে রাখে। এরপর থেকে তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা কমতে থাকে। প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সেখানে ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে।
বনানী থানার ওসি কাজী মইনুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের জমায়েতের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্বানুমতির প্রয়োজন। যেহেতু তাদের পক্ষ থেকে অনুমতি নেয়া হয়নি। এজন্য তাদের কর্মসূচি পালনে সহায়তা করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, ‘মজা লস?’ নামের একটি ফেসবুক পাতার সংগঠক ও ভক্তরা এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কয়েকদিন আগে এই লুঙ্গি মার্চের কর্মসূচি দেয়। এতে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেয় ‘বিডি সাইক্লিং’ নামের ঢাকার সাইকেল একটি আরোহীদের সংগঠন।
বনানী মাঠে বারিধারায় সবাই লুঙ্গি পরে কেউ পদব্রজে আবার অনেকেই সাইকেলে চড়ে মার্চে অংশ নিতে হাজির হয়। বিডি সাইক্লিং এর প্রায় শতাধিক সাইকেল আরোহী লুঙ্গি মার্চে অংশ নিতে আসে।
সামাজিক সংগঠন ‘ভলেন্টিয়ার ফর বাংলাদেশ’র সভাপতি করভী রাখসান্দ বলেন, রিক্সাওয়ালাদের ৩০০ টাকা দিয়ে ট্রাউজার কিনতে বাধ্য করা হয়েছে। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের ওপর এমন সিদ্ধান্ত নির্যাতন ছাড়া কিছুই নয়।
করভী রাখসান্দের সংগঠনরে পক্ষ থেকে আসা তরুণ-তরুণীরা সবাই হলুদ লুঙ্গি পরে ও হলুদ উত্তরীয় গায়ে চড়ানো অবস্থায় ছিল।
বারিধারার বাসিন্দা জার্মান নাগরিক সুমাইয়া আয়ার লুঙ্গি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, এটা অত্যন্ত আরামদায়ক পোশাক, এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কোনো যুক্তি নেই।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান থেকে আসা নাফিসা লুঙ্গি মার্চে অংশ নিতে সেখানে হাজির হন। তার ভাষ্যমতে, লুঙ্গি নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধকে অবমাননা করা হচ্ছে। যেহেতু ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা লুঙ্গি পরে যুদ্ধে নেমেছিলেন।
ডাউন টাউন রাইডারর্স’র পক্ষ থেকে রাজধানীর খিলগাও থেকে আসা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আসিফ ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত খুবই দুঃখজনক।
লুঙ্গি মার্চে অংশ নেয়া ইমরান হোসাইন ইমন লুঙ্গিকে জাতীয় পোশাকের মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলেন। তিনি যুক্তি দেখান এতে সহজে বাতাস প্রবেশ করে, এটি পড়তে আরাম এবং চলাফেরায় ঝামেলাহীন।
Category: 1stpage, দেশের খবর, ব্রেকিং নিউজ, শীর্ষ সংবাদ