সম্পাদকীয় : জোটগত রাজনীতি এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের মৃত্যু।
সম্পাদকীয় : জোটগত রাজনীতি এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের মৃত্যু।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৮টি। কিন্তু, বস্তুত গত দুই মেয়াদের সংসদীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশের মানুষ প্রায় অনেক রাজনৈতিক দলের নামই ভুলতে বসেছে। তার বদলে দেশের মানুষ দুইটি জোটের সাথেই বেশী পরিচিত হয়ে ঊঠেছে। একটি বাম ১৪ দলীয় মহাজোট এবং অন্যটি ডান ১৮ দলীয় জোট। যোগ বিয়োগে যদি ভুল না করে থাকি তাহলে জোটের বাইরে থাকে মাত্র ৬টি দল, যাদের নামের সাথেই হয়তো অনেকে পরিচিত নয়। এই প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ে গেল। হারাধনের ১০টি ছেলে……..একে একে সবাই হারিয়ে গেল। ঠিক বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হারাধনের হারিয়ে যাওয়া ছেলেগুলোর মতো রাজনৈতিক দলগুলোও জোটের মাঝে হারিয়ে গেছে।
এই জোটবদ্ধ দলগুলোর নীতি, আদর্শ এবং রাজনৈতিক দর্শন কি এক? যদি একই হয় তাহলে ভিন্ন ভিন্ন পার্টির নাম দিয়ে দেশের মানুষগুলোকে বোকা বানানোর মানে কি? আর যদি এক না হয়, তাহলে যুগের পর যুগ এই দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে একই সুরে, একই নীতিতে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে আসছে কিভাবে? তাহলে, এখানেও দেশের মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা।
তাহলে, জোটগত রাজনীতির উদ্দেশ্য কি? একদম সহজ ভাষায় যদি বলি তা হল ক্ষমতায় যাওয়া অথবা ক্ষমতা ধরে রাখা। হ্যাঁ, একথা সত্য, সারা বিশ্বে এখন জোট বা কোয়ালিশন সরকার পদ্ধতি অনেক বেশি চর্চা হচ্ছে। কিন্তু, তার সাথে আমাদের দেশের কোয়ালিশন বা জোটের কোনই মিল নেই। আমরা যদি যুক্তরাজ্যের দিকে তাকাই, দেখা যাবে গত ২০১০ এর নির্বাচনে সেই দেশে ক্যামেরুনের কনজারভেটিভ দলের সাথে নিক- ক্লেগের লিব-ডেমের কোয়ালিশন হয়েছে নির্বাচনের পরে এবং সেই ক্ষেত্রে দুই দলকেই কোয়ালিশনের জন্য ঐ দেশের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে একমত হতে হয়েছে। আর আমাদের দেশে কোয়ালিশনের প্রথম শর্তই হচ্ছে কোন দল কয়টা আসন পাবে। জনস্বার্থ এবং দলীয় নীতি বিসর্জন দিতেও আপত্তি নাই। কিন্তু, আসন আমার চাই।
তার জ্বলন্ত উদাহরণ আমরা দেখেছি গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদের জাতীয় পার্টির সকাল বিকাল জোট বদলানো। আর ওনারই বা কি দোষ? সকালে ২০ আসন তো বিকালে ৩০। আর বুদ্ধিমান মানুষতো বেশিটাই নেবেন। তাতে দলীয় নীতি, আদর্শ একটু গেলেও ক্ষতি কি? আর ছোটখাটো দলগুলোর মধ্যে ঐ আসন পলিটিক্স এমনভাবে চেপে বসেছে যে, ওনারাও এখন আর নীতি আদর্শের ধার ধারেন না। অথচ ২০০১ এর নির্বাচনের আগে আমরা দেখেছি, বহুদলীয় গণতন্ত্রে দেশের ছোট দলগুলোও রাজনীতিতে অনেক মূল্যবান ভূমিকা রেখেছে। আজ আসন আর ক্ষমতার লোভে তারাও নিষ্ক্রিয়।
বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চাই একটি দেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। অন্যথায়, আমাদের দেশে কোয়ালিশনের নামে যে জোটগত রাজনীতির প্রবর্তন হয়েছে, তা বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চায় বড় শক্তিশালী অন্তরায়।
আমার দেশে যখন দেখি ৩৮টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ৩২টি দলই দুইটি জোটের অন্তর্গত তখন আবার জোট নিবন্ধনের কোন আইন প্রবর্তন হবে কিনা তা ভেবে সংকিত হই। অথবা, মরিশাসের মতো দেশের সবগুলো দল দুটি জোটে বিভক্ত হয়ে পরে আবার ক্ষমতা ভাগাভাগির জন্য ঐ দুই জোটই কোয়ালিশন করবে কিনা কে বলতে পারে? কারণ, ক্ষমতাই যেখানে টার্গেট সেখানে সবই সম্ভব।
উন্নত দেশগুলোতে কোয়ালিশন সরকার দেখে আমরা তার ভুল প্রয়োগ করছি। কথায় আছে- “ বিজ্ঞান আশীর্বাদ কিন্তু মানুষের ব্যবহারের ভুলে তা হয়ে যায় অভিশাপ।
সুতরাং, আমাদের দেশের জোটবদ্ধ দলগুলোকে শুধু ক্ষমতা বা আসনের কোয়ালিশন চর্চা করলে হবে না, দেশের মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়েই রাজনীতি করতে হবে। তবেই আমরা পাবো একটি বহুদলীয় শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যবস্থা। অন্যথায়, বহুদলীয় গণতন্ত্রের মৃত্যু হবে যা কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়।
Category: সম্পাদকীয়