দীর্ঘ ৫ বছর লন্ডন নির্বাসনের পর তারেক রহমানের প্রকাশ্য রাজনীতিতে পুনরাগমন
ইউরো সংবাদ: ৫ই মে দিবাগত রাতে শাপলা চত্বরে হেফাজত সমাবেশে র্যাব-পুলিশের অ্যাকশনের প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘রাতের অন্ধকারে বাতি নিভিয়ে সমাবেশে আক্রমণ, মানুষ হত্যা, এ কোন গণতন্ত্র?
তিনি ঐ সমাবেশে অগণিত মানুষ হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে বলেন, বর্তমান সরকারকে এই হত্যাকা-ের দায় নিতে হবে।
সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত দেড়টায় পূর্ব লন্ডনের নিউহ্যাম পামট্রি রেস্টুরেন্টে ডকল্যান্ড ক্রাউন প্লাজা হোটেলে প- হওয়া অসমাপ্ত সমাবেশের সমাপনী বক্তব্যে তারেক রহমান সরকারের বিরুদ্ধে রাতের অন্ধকারে বাতি নিভিয়ে মানুষ হত্যার এই অভিযোগ করেন।
দলের যুক্তরাজ্য শাখার বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ নেতৃস্থানীয় কর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্য বিএনপি’র সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি শায়েস্তা চৌধুরী কুদ্দুস।
নিউহ্যাম বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম ও যুগ্ম সম্পাদক ফেরদৌস আলমের যৌথ পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে বিভিন্ন শাখা কমিটির নেতৃবৃন্দসহ প্রায় দেড়শতাধিক নেতা বক্তব্য রাখেন।
স্থানীয় নেতাদের আবেগ, অভিযোগ, পরামর্শপূর্ণ এইসব বক্তব্য দীর্ঘক্ষণ যাবত মন দিয়ে শোনেন তারেক রহমান।
সমাপনী বক্তব্যে দেশ ও জাতীর বর্তমান ক্রান্তিকালে ব্যক্তিগত ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়ার আহবান জানান তিনি।
তারেক বলেন, দেশ আজ স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। জনগণ আজ নিরাপত্বাহীন, মানবাধিকার লক্সিঘত হচ্ছে প্রতি মূহূর্তে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা স্তব্ধ করে দিতে বাকশালী কায়দায় সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকারের দলীয় করণ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সরব হলেই সাংবাদিকদের ওপর নেমে আসছে হত্যার খড়গ।
এ সময় সমাবেশে উপস্থিত দৈনিক আমার দেশের একজন সাংবাদিককে দেখিয়ে তিনি বলেন, নিজের প্রাণ বাঁচাতে এই সাংবাদিক আজ দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন। ঐ সাংবাদিকের কাছ থেকে সংখ্যা জেনে নিয়ে তারেক বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে এই পরযন্ত প্রায় ২০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে।
দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র এ শীর্ষ নেতা অভিযোগ করেন, সাংবাদিক সাগর-রুনি সরকারের একটি বড় ধরনের দুর্নীতি প্রকাশ করতে যাচ্ছিলেন বলেই তাদের হত্যা করা হয়। তিনি আরও অভিযোগ করেন, সাগর-রুনির হত্যাকা-কে ধামাচাপা দিতে সরকারি পৃষ্টপোষকতায় এখন চলছে বিভিন্ন নাঠক।
ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে বর্তমান সরকার তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে অভিযোগ করে তারেক বলেন, একটি শীর্ষ পত্রিকার কয়েক হাজার পাঠকের ওপর করা জরিপে প্রমাণ হয়েছে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ তত্বাবধায়ক সিস্টেম চায়। কিন্তু সরকার জনমতের প্রতি কোন রখম তোয়াক্কা না করেই এক তরফা নির্বাচনের দিকে হাঠছে বলেই মনে হচ্ছে।
তারেক বলেন, জনগনের প্রয়োজনেই বিএনপি’র জন্ম হয়েছিল। সুতরাং এই জনগনের প্রয়োজনেই দলকে সুসংগঠিত করে বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরোদ্ধে আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে। নিজেদের অভ্যন্তরীণ সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ব্রিটেনে দলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, কেন্দ্রীয় বিএনপি আশা করছে, অচিরেই যুক্তরাজ্য বিএনপি’র এমন একটি কমিটি আপনারা দলকে উপহার দেবেন, যে কমিটিতে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে ঘটবে, ত্যাগী, দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের সমাবেশ। আশাকরি আপনারা সবাই সেই রখম একটি কমিটির পক্ষে মতামত দেবেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পরযায়ে দলকে তুলে ধরতে যুক্তরাজ্য বিএনপি’র একটি দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব সম্পন্ন কমিটি এখন সময়ের দাবী, এবং অচিরেই উপরোক্ত গুনাবলী সম্পন্ন একটি কমিটি আসবে বলে আমি আশাবাদী।
তাঁকে দেশে ফিরে দলের হাল ধরার নেতাকর্মীদের আহবানের জবাব দিতে গিয়ে তারেক জানান, তিনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন। বেশি সময় দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেন না, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়।
নেতাকর্মীরা লন্ডনের বাইরে অন্যান্য শহরেও তাঁকে নিয়ে সমাবেশ করার আগ্রহ দেখালে তারেক বলেন, যুক্তরাজ্য বিএনপি’র নতুন কমিটি গঠিত হওয়ার পর ইনশাল্লাহ ব্রিটেনের অন্যান্য শহরে গিয়েও আমি নেতাকর্মীদের সাথে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করবো।
তারেক রহমান প্রায় আধাঘণ্টার মত সময় বক্তব্য রাখেন নেতাকর্মীদের উদ্দেশে। তারেক ছাড়াও সমাবেশে উল্লেখযোগ্য অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দলের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মহিদুর রহমান, বাতিলকৃত আহবায়ক কমিটির আহবায়ক এম এ মালেক, যুগ্ম আহবায়ক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিষ্টার এম এ সালাম, এনামুল হক লিটন, সাবেক যুগ্ন সম্পাদক মল্লিক হোসাইন আহমেদ হাসনু, নাসিম চৌধুরী, কয়সর আহমেদ, জমিলুল হক, ফযসল আহমেদ, এম লুৎফুর কল্যান্ড ক্রাউন প্লাজা রেষ্টুরেন্টে আয়োজিত দলের এই সভা কর্মীদের হাতাহাতি ও উত্তেজনার কারণে প- হয়ে যারহমান, মোশাহিদ হোসেইন ও এম জাহেদ আলী প্রমুখ।
পামট্রি রেষ্টুরেন্টের আগে সোমবার দুপুরে পূর্ব লন্ডনের ডয়। অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ নিয়ে বিরোধী গ্র“পের কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি ও উত্তেজনা শুরু হলে ক্রাউন প্লাজা কর্তৃপক্ষ পুলিশ ডাকলে পুলিশ এসে সমাবেশ বন্ধ করে দিয়ে স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেয় সকলকে।
সভার সূচনা বক্তব্য রাখতে গিয়ে ঐ সময় তারেক রহমান বিগত দিনে রাজনৈতিক কারণে মৃত্যু ও নিরযাতন ভোগকারী দলীয় নেতাকর্মীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্য বিএনপি’র একটি শক্তিশালী কমিটি এখন সময়ের দাবি উল্লেখ করে তারেক বলেন, ত্যাগী, যোগ্য ও দক্ষ নেতাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের পরামর্শের জন্যেই আজ দলের বিভিন্ন শাখা নেতৃবন্দকে এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
এরপর দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তারেক রাজনৈতিক বক্তব্য শুরু করার মুহুর্তেই বিরোধী কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। উত্তেজনা সংঘর্ষের দিকে ধাবিত হলে পুলিশ এসে হস্তক্ষেপ করে সভায়। পরবর্তীতে তাৎক্ষনিক নিউহ্যামের পামট্রি রেস্টুরেন্টে অসমাপ্ত সভা পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেতকর্মীদের সেখানে চলে যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সময় রাত ১১টার দিকে পামট্রি রেস্টুরেন্টে অসমাপ্ত সভা শুরু হয়ে তা চলে বাংলাদেশ সময় রাত আনুমানিক ২টা পরযন্ত।
উল্লেখ্য, বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় লন্ডন নির্বাসনে আসার পর দলের বিভিন্ন শাখা কমিটির নেতাদের নিয়ে তারেক রহমানের প্রকাশ্য সভা কারযত এই প্রথম। গত দুয়েক দিন ধরে এই সভা নিয়ে বিভিন্ন গুজব গুঞ্জন চলছিল লন্ডনের কমিউনিটিতে। দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতৃত্বহীন ভাবে চলছিল।
সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম এ মালেকের নেতৃত্বাধীন আহবায়ক কমিটি বাতিল করার পর যুক্তরাজ্য বিএনপি অনেকটা কা-ারীবিহীন ভাবে অঙ্গ সংগঠনগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহনের মাধ্যমে দলীয় অস্থিত্ব ঠিকিয়ে রাখছিল।
কয়েক সপ্তাহ আগে উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে গিয়ে রাজনৈতিক সমাবেশে যোগদান করায়, লন্ডনেও তারেক শিগগিরই প্রক্শ্যা রাজনৈতিক কর্মকা- শুরু করবেন, এমনটি শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় হচ্ছেন তারেক, এমন আলোচনা লন্ডনের কমিউনিটিতে ডালপালা বিস্তার করে গত কয়েক দিন ধরে।
যুক্তরাজ্য বিএনপি’র নতুন কমিটি নিয়ে বিগত বেশ কয়েকদিন যাবত টানা কাজ করার পর একটি কমিটি এরইমধ্যে ঠিকও করেছেন তারেক, এমন খবরই আলোচিত হচ্ছিল বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে। এরমধ্যে গত শুক্রবার তিনি বেলজিয়াম গিয়েছেন বলেও গুজব ওঠে কমিউনিটিতে। হঠাৎ করে কেন তাঁর এই বেলজিয়াম যাত্রা, এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খেতে থাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
বেলজিয়াম যাত্রার খবরের পাশাপাশি সোমবার তারেক নেতাকর্মীদের সামনে প্রকাশ্যে আসছেন এমন খবরও প্রচার হয়। খবর প্রচারের পাশাপাশি কে আসছেন যুক্তরাজ্য বিএনপি’র নেতৃত্বে, এমন প্রশ্নেও নির্ঘুম রাত কাটাতে থাকেন নেতৃত্ব প্রত্যাশী নেতারা। সোমবারের সভায় নিজের বক্তৃতায় অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায় যুক্তরাজ্য বিএনপি’র কমিটি গঠন চূড়ান্ত করেছেন তারেক রহমান। চূড়ান্তকৃত কমিটির নেতৃত্বে কে আসছেন এটিই এখন দেখার বিষয়। আর এই টেনশন নিয়েই সোমবার রাতে ঘরে ফিরে গেছেন নেতৃত্ব প্রত্যাশী যুক্তরাজ্য বিএনপি’র নেতারা।
কমিটি ঘোষণা না হওয়া পরযন্ত বাকী প্রতিটি রাতই হয়তো নির্ঘুমই কাটবে তাদের। আর সোমবার লন্ডনের কর্মী সমাবেশে সরকারের বিরোদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উথ্থাপনের মাধ্যমে দীর্ঘ ৫ বছর লন্ডন নির্বাসনে নিরব থাকা তারেক আবারও সরব হলেন, প্রকাশ্য পুনরাগমন করলেন আবার রাজনীতিতে, এমনটিই ধারণা করা হচ্ছে।
এর আগে নেতৃস্থানীয় কারো কারো সাথে আরও দু’য়েকটি রুদ্ধদ্বার ঘরোয়া সভায় যোগদান করলেও সোমবারের মত প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করে এমন বক্তব্য রাখেননি তিনি। তারেকের এই প্রকাশ্যে রাজনীতিতে পুনরাগমন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্যে টার্নিং পয়েণ্ট কি না তা এখন সময়ই বলে দেবে।
Category: 1stpage, Community UK, Scroll_Head_Line, ইউরোবিডি কমিউনিটি সংবাদ