নীতিমালা না মেনে রাজধানীতেই চলছে ২০ হাজার কিন্ডারগার্টেন
স্টুডেন্ট কর্ণার : কোন নীতিমালা না মেনেই রাজধানীতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে নিবন্ধনবিহীন ২০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিবছর ভর্তি ফি, মোটা অংকের টিউশন ফি, লিখিত, অলিখিতভাবে বিভিন্ন ফি আদায় করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এসব স্কুলে শিক্ষার কোন পরিবেশ নেই। নেই পর্যাপ্ত ক্লাস রুম, খেলার মাঠ। প্রশিক্ষণ নেই শিক্ষকদেরও। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাস না পড়িয়ে পড়ানো হয় বিদেশীদের ইতিহাস। ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন আগ্রহই নেই। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা এসব কিন্ডারগার্টেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষ বলেছেন যেসকল কিন্ডারগার্টেন স্কুল কোন নিয়মনীতি মানছে না তাদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কোথাও দুটি রুম, কোথাও বা তার বেশি রুম নিয়ে রাজধানীর অলিগলিতে গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল। তথাকথিত উচ্চ শিক্ষার বাসনা নিয়ে অভিভাবকরাও এসব স্কুলে তাদের সন্তানদের ভর্তি করছে। অথচ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশরই নেই কোন নিবন্ধন। পাঠ্যদান ও শিক্ষা কার্যক্রম পদ্ধতিও পরিচালিত হয় নিজেদের মন মতো। অথচ কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার গত বছর একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। নীতিমালা অনুযায়ি গত বছরের জুন মাসের মধ্যে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর নিবন্ধন করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু বেধে দেয়া সময় তো দূরের কথা চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত মাত্র দুই হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে। তবে এর আগে কিছুটা ছাড়া দিলেও এবার আর কোন ছাড়া দেয়া হচ্ছে না বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানানো হয়েছে, যেসকল কিন্ডারগার্টেন নিবন্ধন ছাড়া কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তাদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে। তালিকা প্রণয়ন শেষ হলেই নিবন্ধন ছাড়া পরিচালিত কিন্ডারগার্টেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর বেশিরভাগেরই নেই কোন শিক্ষার পরিবেশ। স্কুলগুলোতে নেই পর্যাপ্ত ক্লাস রুম, ইনডোর সুযোগ-সুবিধা, খেলার মাঠ এমনকি গ্রন্থাগারও। আর এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কেউই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নয়। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য কোন ব্যবস্থাও গ্রহণ করেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ। পাঠদানের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় না শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কোন নির্দেশনা। বাংলাদেশের ’স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বেও বিরোধী ও বাংলাদেশী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ পরিপন্থী বইও পড়ানো হয় অনেক কিন্ডারগার্টেনে। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাস না পড়িয়ে পড়ানো হয় বিদেশীদের ইতিহাস। ধর্মীয় শিক্ষাদানে এসব প্রতিষ্ঠানের কোন আগ্রহই নেই। তবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বছর বছর ভর্তি ফি, মোটা অংকের টিউশন ফি, লিখিত, অলিখিতভাবে বিভিন্ন ফি আদায় করতে মোটেও ভুল করেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শিক্ষাদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের বেতন, আর্থিক সুবিধা দেয়া হয় অনেক কম।
নিবন্ধনহীন কিন্ডারগার্টেনের তালিকা প্রণয়ন : রাজধানীর অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠলেও এর অধিকাংশেরই কোন নিবন্ধন নেই। এমনকি ঠিক কি পরিমাণ কিন্ডারগার্টেন স্কুল রাজধানীতে শিক্ষাকার্যক্রম চালাচ্ছে তারও কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। তবে মন্ত্রণালয়ের এক অনানুষ্ঠানিক তথ্য অনুসারে রাজধানীতে প্রায় ২০ হাজারের উপর কিন্ডারগার্টেন প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুল কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর আগে গত বছর কিন্ডারগার্টেন স্কুল নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি নীতিমালা করা হয়। নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিজস্ব মালিকানায় অথবা ভাড়ায় মহানগর এলাকায় অন্তত আট শতাংশ, পৌর এলাকায় অন্তত ১২ শতাংশ ও অন্যান্য এলাকায় ৩০ শতাংশ ভূমি এবং এই ভূমির উপর অন্তত ৩ হাজার বর্গফুটের কমপক্ষে ছয় কক্ষের ভবন থাকতে হবে। কিছু সংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানেই এই পরিমাণ খোলা জমি ও অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথেচ্ছ টিউশন ফি ও লিখিত, অলিখিত অন্যান্য ফি আদায় প্রবণতা রোধ করতে ’স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটিকে টিউশন ফি নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। শিক্ষার গুণগতমান ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে এই ফি নির্ধারিত হবে। ভর্তির বিপরীতে, ভর্তি নবায়ন বা পুনঃভর্তির নামে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অনুদান বাবদ অর্থ আদায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ফি আদায় করা যাবে। তাও ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে অনুমোদিত হতে হবে এবং তার পূর্ণাঙ্গ ব্যয় বিবরণী অভিভাবকদের জানাতে হবে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর জন্য নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন তিনজন মহিলা শিক্ষকসহ কমপক্ষে ছয়জন শিক্ষক থাকতে হবে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত খোলা সম্ভব না হলে অন্তত তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করে কার্যক্রম শুরু করা যাবে। বিদ্যালয় পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে। শিক্ষকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত একজন, মেধাবী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত একজন, অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকগণের মধ্য থেকে নির্বাচিত দু’জন, উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠাতাগণের মধ্য হতে নির্বাচিত বা মনোনীত ৩ জন প্রতিনিধি থাকবেন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক হবেন সদস্য সচিব। পার্শ্ববর্তী-নিকটতম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকও কমিটিতে সদস্য থাকবেন। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ, শিক্ষক-কর্মচারীদের ব্যাপারে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফি নির্ধারণ, আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষার ব্যবস্থাগ্রহণ, শিক্ষারমান ও পরিবেশ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে কমিটির দায়িত্ব। কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠার জন্য মহানগর এলাকায় প্রথমে ১ লাখ টাকা, জেলা সদরে ৭৫ হাজার টাকা, উপজেলা সদর ও পৌরসভা এলাকায় ৫০ হাজার টাকা, ইউনিয়ন পর্যায়ে ২৫ হাজার টাকা তহবিল নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে তা কমিয়ে যথাক্রমে ৫০ হাজার, ৩০ হাজার, ২৫ হাজার ও ১৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। নিবন্ধন ফি ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়েছে। ইচ্ছামতো পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করে পাঠদান ব্যবস্থাও রহিত করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমোদিত বই আবশ্যিকভাবে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্তি ও আন্তর্জাতিক মানের সাথে বজায় রাখতে শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হবে। পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কোন বই পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। অন্তর্ভুক্ত করা হলে বাধ্যতামূলকভাবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের প্রাক অনুমতি নিতে হবে বলে সেই নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। এই নীতিমালা অনুযায়ি স্কুলগুলোকে নিবন্ধনের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু জুলাই মাস পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে মাত্র দুই হাজার আবেদন জমা পড়েছে। তাই আর কোন সুযোগ না দিয়ে এবার নিবন্ধনহীন কিন্ডারগার্টেনগুলোর তালিকা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেপ্টেম্বর মাস থেকেই তালিকা তৈরির কাজ শুরু হবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। আর যেসব কিন্ডারগার্টেন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে তাদের নীতিমালা মানার বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হবে বলে জানা গেছে। নীতিমালা অমান্যকারী এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ তিনলাখ টাকা অর্থদ- অথবা ৬ মাস কারাদ- অথবা উভয়দ-ে দ-িত করার বিধানও রাখা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষ বলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো নিজের ইচ্ছামত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা একটি নীতিমালা করেছি। কিন্তু সেই নীতিমালাও অনেক প্রতিষ্ঠান মানছে না। এসব বিষয়ে শীঘ্রই আমরা ব্যবস্থা নিব।
Category: 1stpage, দেশের খবর, স্টুডেন্ট কর্ণার