আগামী ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনীর ৩টি আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা
ওছমান হারুন মাহমুদ, ফেনী ॥ আগামী ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি ফেনীর ৩টি আসনে নিজেদের জয় নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে মাঠে নামছে। এসব দলে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পদচারণার ঢেউ শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত গ্রামের বাজারেও লেগেছে।
ফেনী-১ আসন (পরশুরাম-ফুলগাজী-ছাগলনাইয়া) ॥ ফেনী-১ আসন ভিআইপি আসন হিসেবে চিহ্নিত। এ আসনে ১৯৯১ সাল থেকে চলতি ৯ম সংসদ পর্যন্ত বিএনপি প্রার্থী হিসেবে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন করে জয় লাভ করে আসছেন। আসন্ন ১০ম সংসদ নির্বাচনেও তিনি এ আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে প্রচার রয়েছে।
আওয়ামী লীগ থেকে এ আসনে একক কেউ ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন করেনি। আগামী ১০ম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করছে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মনোনয়ন। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামের প্রার্থিতা অনেকটা নিশ্চিত বলে দলের শীর্ষনেতাদের সূত্রে জানা গেছে। কারণ এ আসনে বেগম জিয়ার ইমেজের সঙ্গে মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাঠ দখলে রাখার মতো বর্তমানে তিনি ছাড়া তেমন কেউ নেই। এলাকার অধিবাসী অথচ ঢাকা-চট্টগ্রামে অবস্থান করে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন এমন যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে অনেকে হেরে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নয়। গত ৫ বছরে ফেনী আওয়ামী লীগের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক ’৯৬-এর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার বর্তমান আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আলাউদ্দিন আহম্মদ নাসিম পর্দার অন্তরালে থেকে জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপর্ণ সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনে এবং কেন্দ্র ও জেলা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর প্রভাব রয়েছে।
আলাউদ্দিন নাসিম দীর্ঘ ৫ বছর পর্দার অন্তরালে থাকার পর হঠাৎ করে তিনি গত ২৬ আগস্ট প্রথম ছাগলনাইয়াতে আওয়ামী লীগের কর্মিসভায় প্রধান অতিথি থাকবেন বলে প্রচার চালানো হয়। পরে উক্ত সভা স্থগিত করা হয়। এ সভার প্রচারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী পরিবারের সচেতন নেতাকর্মীদের ধারণা, বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ না নিলে তিনি এ আসন থেকে মনোনয়ন নেবেন এবং কোন ঝুঁকি ছাড়া জয়লাভ করবেন। এ ছাড়া একসময়ের বিএনপি, জাপার মন্ত্রী লে. কর্নেল জাফর ইমাম বীরবিক্রম (অব) ১৯৭৯ সাল থেকে বিএনপি, পরে জাপা থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত এ আসনের এমপি-মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯১ সালে জাপা প্রার্থী এবং ২০০১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এ আসন থেকে নির্বাচন করে বেগম জিয়ার সঙ্গে হেরে যান। তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, তিনি হয়ত আবার বিএনপিতে ফিরে গিয়ে এ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন। জাফর ইমামের বিষয়টি বাদ গেলে এবং বেগম জিয়া এ আসনে নির্বাচন না করলে শিল্পপতি আবুল কাশেম, শিল্পপতি নুরনেয়াজ সেলিম মনোনয়ন চাইতে পারেন। যুবলীগ নেতা খায়রুল বসর তপন, কামাল উদ্দিন আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইবেন।
ফেনী-২ আসন (সদর) ॥ ২০০৮ সাল থেকে ফেনী-২ আসন শুধু ফেনী সদর উপজেলা নিয়ে করা হয়েছে। আগে এ আসনের সঙ্গে দাগনভুঞা উপজেলা সংযুক্ত ছিল। বর্তমানে দাগনভুঞা উপজেলা ফেনী-৩ আসনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ফেনী-৩ আসনের সঙ্গে থাকা ফেনী সদর থানার ৫টি ইউনিয়নও ফেনী-২ আসনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়নাল হাজারী জয়লাভ করেছেন। ২০০১ সালে যৌথবাহিনীর অভিযানে জয়নাল হাজারী আত্মগোপনে যাওয়ার পর আত্মগোপন থেকে মনোনয়ন জমা দিয়ে নির্বাচন করেন। সে সময় ১৯৯৭তে জাসদ থেকে বিএনপিতে যোগদান করা জয়নাল আবদীন (ভিপি জয়নাল) জয়লাভ করেন। জয়নাল হাজারীর বিভিন্ন কাজে মানুষ আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বিকল্প না থাকায় ভিপি জয়নালকে ভোট দেয়। বাস্তবে জয়নাল হাজারী এবং ভিপি জয়নালের কর্মকা- মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। জয়নাল হাজারীর কর্মকা- ছিল সরব আর ভিপি জয়নালের টা নীরব। জেলা কমিটি নিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের মূলব্যক্তি ভিপি জয়নাল সম্প্রতি সংসদীয় দলের প্রতিনিধি হয়ে ইউরোপ সফরের সময় লন্ডনে তারেক জিয়ার সঙ্গে দেড় ঘণ্টা বৈঠক করে মনোনয়ন নিশ্চিত করেছেন বলে তাঁর অনুসারীরা প্রচার চালাচ্ছেন। এ কারণে তিনি বর্তমানে ফুরফুরে মেজাজে সময় কাটালেও দলীয় কোন কর্মকা-ে তেমন দেখা যাচ্ছে না।
দলীয় একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ফেনী বিএনপিতে ২০০১ সালের আগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তেমন ছিল না। ভিপি জয়নাল আসার পর প্রভাব বিস্তার এবং নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার কারণে এ কোন্দল প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ত্যাগী বিএনপি নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে গেছে ভিপির কূটচালের কারণে। ২০০৩ সালে তাঁর কূটচালে ফেনী টাউন হলের সম্মেলনে হামলার ঘটনায় মহাসচিব আবদুল মন্নান ভুঞা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, এই ভিপি জয়নাল ১/১১-এর সময় সংস্কার বাদী হিসেবে চিহ্নিত হলেও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং ফেনী-৩ আসনের এমপি মোশারফ হোসেনের সর্বাত্মক চেষ্টায় ২০০৮ সালে এ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন।’
সে সময় এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী এলাকায় নতুন মুখ এবং আগে থেকে জনসংযোগ না থাকায় হেরে যান। অবস্থাটা এমন হয়ে ছিল যে, তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ির সামনের কেন্দ্রেও জিততে পারেননি। ভিপি জয়নাল ’৭২ সাল থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত জাসদের মশাল এবং চরকার প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে ৩-৪ হাজার ভোট পেতেন। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে ’৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া নির্বাচনে স্কপের প্রার্থী হিসেবে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। ’৯৭ সালে বিএনপিতে যোগদানের পর ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের প্রতীক ধানের শীষের কারণে জয়লাভ করেন তিনি। আর ইকবাল সোবহান চৌধুরী নতুন মুখ এবং আগে থেকে এলাকায় গণসংযোগ না থাকা সত্ত্বেও নৌকা প্রতীকের কারণে ৮৭ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়ে হেরে যান। বর্তমান নির্বাচনমুখী সময়েও ফেনীতে তাঁর কোন জনসংযোগ নেই।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে পৌরমেয়র নিজাম উদ্দিন হাজারী গত ৩ বছর থেকে বিভিন্ন উপলক্ষ নিয়ে সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ চালিয়ে আসছেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর কাউন্সিল করে জেলা কমিটি একই সঙ্গে সারা জেলায় তৃণমূল পর্যায়ের কমিটি পুনর্গঠন করে তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করে দলের ভিত শক্ত অবস্থানে নিয়েছেন। ফেনীতে বিএনপি, জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দলের সহাবস্থান করে বোমাবাজি, সন্ত্রাস বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন বলে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীসহ সচেতন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে। বর্তমানে দলের কর্মকা-ে নিষ্ক্রিয় সাবেক এমপি জয়নাল হাজারী ফেনীতে অনুপস্থিত থাকলেও দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তবে তিনি মনোনয়ন নাও চাইতে পারেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে।
এছাড়া গত নির্বাচনের প্রার্থী ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বর্তমান জেলা পরিষদ প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আজিজ আহম্মদ চৌধুরী, বর্তমান সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট আক্রামুজ্জামান মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন। বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি রেহানা আক্তার রানু, সাবেক হুইপ মাহবুবুল আলম তারা, জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন মাস্টার, এ্যাডভোকেট সৈয়দ মিজানুর রহমান, ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবদলের সভাপতি রফিকুল আলম মজনুর নাম শোনা যাচ্ছে। এছাড়া সাবেক আমলা বিএনপি আমলের জাতিসংঘের বাংলাদেশ প্রতিনিধি সৈয়দ হাসান আহম্মদ চৌধুরী ওপর থেকে মনোনয়ন নিয়ে আসতে পারেন।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছেন, ঘটনা পরিক্রমায় বেগম জিয়া ফেনী-১ আসনে নির্বাচন না করে ফেনী-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনসহ আসনটিতে বিএনপির জয় নিশ্চিত করার জন্য দলের একটি অংশ এ নিয়ে হাইকমান্ডে তদ্বির চালিয়ে আসছে। ফেনী-২ আসনে জাপা (এ) মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থী হিসেবে শিল্পপতি হাজী আলাউদ্দিন গত এক বছর থেকে পুরো নির্বাচনী এলাকায় সভা-সমাবেশ করে আসছেন। বিভিন্নস্থানে লাগানো হয়েছে লাঙ্গলের প্রতীকসহ তার পোট্রেট, পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার। জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে জেলার সাবেক আমির লিয়াকত আলী ভূঞা রয়েছেন। ১৮ দলের কাছে ফেনী-২ আসনটি জামায়াতকে ছেড়ে দেয়ার দাবি তুলেছে জামায়াতের নেতাকর্মীরা। তবে বর্তমান পরিস্থিতির কারণে জামায়াত এখন আর এ দাবি নিয়ে মুখ খুলছে না।
ফেনী-৩ আসন (সোনাগাজী-দাগনভূঞা) ॥ ফেনী-৩ আসন ৯ম সংসদ নির্বাচন থেকে সোনাগাজী ও দাগনভুঞা উপজেলা নিয়ে করা হয়েছে। এ আসনে আগের সীমানায় ফেনী সদরের যে ৫টি ইউনিয়ন ফেনী-৩-এর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল সেগুলো কেটে ফেনী-২ আসনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। ফেনীর অন্য ২টি আসনের মতো এ আসনেও প্রধান দুই দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা মাঠে নামতে শুরু করেছে। ঈদের সময় নিজ দলীয় এবং নিজের অনুসারীদের ঈদ শুভেচ্ছা, উপঢৌকন বিতরণ রাস্তায় পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার লাগানো কিছুই কমতি ছিল না। ১৯৯১ সাল থেকে চলতি সংসদ পর্যন্ত এ আসনটি বিএনপির দখলে রয়েছে।
সমুদ্র উপকূলীয় সোনাগাজীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনবান্ধব তেমন নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। বিএনপির চেয়ারপার্সনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বর্তমান এমপি মোশারফ হোসেন এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইলেই মনোনয়ন পাবেন এটা নিশ্চিত বলে দলের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে নির্বাচন না করার সম্ভাবনা রয়েছে। এ আসনে বিএনপির আরেক প্রভাবশালী ব্যক্তি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুও মনোনয়ন চাইতে পারেন। এ ছাড়া সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন আহম্মদ (অব) গত ক’মাস থেকে বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন বলে এলাকায় জনসংযোগ শুরু করে মাঠ তৈরিতে সময় দিচ্ছেন।
এছাড়া ঈদে ফেনী-৩ আসনের জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টার লাগিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দফতর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি। এ আসনে সোনাগাজী থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন, সৌদি আরবের জেদ্দা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী রহিম উল্যা, ডা. গোলাম মাওলা, দাগনভুঞা থেকে গতবারে প্রার্থী আবুল বসর, আক্রাম হোসেন হুমায়ুন মনোনয়ন চাইবেন। জাপার (এ) পক্ষ থেকে মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থী হিসেবে গত ক’মাস যাবত সোনাগাজী-দাগনভুঞা এলাকার তৃণমূলের কমিটি পুনর্গঠনসহ সভা-সমাবেশ করে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের তথ্য ও গবেষণা উপদেষ্টা রিন্টু আনোয়ার।
source: Janakantha