হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাব না- খুলনার জনসভায় খালেদা
দেশের খবর: বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘সারা দেশের মানুষ জেগে উঠেছে। সরকার যদি সংসদে দ্রুত বিল না আনে, তাহলে মানুষের যে স্ফুলিঙ্গ আমি দেখেছি, তা ঠেকানোর ক্ষমতা কারো থাকবে না। তাই শেখ হাসিনাকে বলব, এখনো সময় আছে, সংসদে বিল এনে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ব্যবস্থা করুন।’
গত রবিবার খুলনা সার্কিট হাউস মাঠে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট আয়োজিত বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা না হলে ২৫ অক্টোবরের পর সরকার পতনের আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হবে জানিয়ে জনগণকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।
বিরোধীদলীয় নেতা প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষায় আপনারা নির্ভয়ে কাজ করুন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। এ সরকার আপনাদের ঘরে পাঠিয়ে দিতে পারবে না। বরং এ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় এসেছে।’ তিনি বলেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনে শুধু নির্বাচন বর্জনই নয়। নির্বাচন করার চেষ্টা হলে তা প্রতিহত করা হবে। সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে দেওয়া হবে না। এ প্রকল্প বন্ধ করে অন্য এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করুন। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির যে লংমার্চ কর্মসূচি চলছে, আমরা তাদের পক্ষে আছি। এ কমিটি যত সহযোগিতা চাইবে, তা দেওয়া হবে। দেশ ডাকাতের হাতে পড়েছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, এই সরকার ডাকাতি করে সব কিছু নিয়ে গেছে। ডাকাতের হাত থেকে দেশ রক্ষা করতে হবে।
জনসভায় সভাপতিত্ব করেন খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু এমপি। সভা পরিচালনা করেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম মনা। তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক মাজেদুল ইসলাম এবং খুলনা সিটি মেয়র বিএনপি নেতা মনিরুজ্জামান মনি প্রমুখ।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিচারপতি কে এম হাসানকে সাংবিধানিকভাবে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করতে চেয়ছিলাম। তখন আওয়ামী লীগ তাঁকে মানেনি। তাহলে আমরা কেন শেখ হাসিনাকে মানব। শেখ হাসিনার অধীনে আমরা নির্বাচনে যাব না, যাব না।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশটাকে বিদেশের হাতে তুলে দিতে চায়। ক্ষমতায় থেকে সংবিধান এমনভাবে সংশোধন করেছে যে তারা চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে। কিন্তু এই সরকারের জনরোষ ঠেকানোর কোনো সাধ্য নেই।
খুলনাবাসীর উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এই এলাকার মানুষ সরকারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। এ জন্য এই এলাকার মানুষদের ধন্যবাদ। সিটি নির্বাচনের পর এই সরকার ভয় পাচ্ছে। এ জন্যই দলীয় সরকারের অধীনে এককভাবে নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না, হতেও দেওয়া হবে না। রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করতে হবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ক্ষমতায় আসবে। এরপর শুরু হবে আমাদের মহাপরিকল্পনা। আমরা নতুনধারার সরকার ও রাজনীতি করব।’ দেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আসুন প্রতিহিংসার রাজনীতি নয়, ঐক্যের রাজনীতি করি।
খালেদা জিয়া আরো বলেন, দেশ বাঁচাতে আওয়ামী লীগ হটাতে হবে, ইমান রক্ষা করতে হবে, ইসলাম বাঁচাতে হবে। ঢাকার রাজপথের আন্দোলনে আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে। সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে নির্বাচনের কথা বলতে আসিনি। এসেছি নির্দলীয় সরকারের দাবি জানাতে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের এমন ভরাডুবি হবে যে তারা মুখ দেখাতে পারবে না।’
খুলনা শিল্প এলাকার ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আওয়ামী লীগ শিল্প-কারখানা ধ্বংস করে ফেলেছে। এই সরকার পাটশিল্পও ধ্বংস করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে খুলনাকে আবার শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। এই এলাকায় একটি ইপিজেড নির্মাণ করা হবে। মংলা বন্দরের মান উন্নয়ন করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা খুলনায় রূপসা সেতু করেছি। কিন্তু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন আওয়ামী লীগ হরতাল দিয়েছিল। এই এলাকার মানুষের দাবি ছিল পদ্মা সেতুর। এ সরকার পদ্মা সেতু করতে পারেনি। আমরা ক্ষমতায় গেলে মাওয়া ও পাটুরিয়া দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু করব।’
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, এই সরকার দেশের কোনো উন্নয়ন করতে পারেনি। শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, পাঁচটি সরকারি ব্যাংকের টাকা লুট করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়া করেছে। সোনালী ব্যাংককে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে ৩০৯ বছর সময় লাগবে।
দ্রব্যমূল্য তিন থেকে চার গুণ বেড়ে গেছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, পেঁয়াজের কেজি এখন ৮০ টাকা। অথচ এই সরকার তাদের নির্বাচনী ওয়াদায় বলেছিল ১০ টাকা কেজি দরে চাল ও বিনা মূল্যে কৃষকদের সার দেবে। ঘরে ঘরে চাকরি দেবে। ঘরে ঘরে চাকরি দূরে থাক, মানুষ এখন বিদেশ থেকে ফেরত আসছে। এই সরকার যত দিন ক্ষমতায় থাকবে, ততই দেশের ক্ষতি হবে।
গ্রামীণ ব্যাংক দলীয়করণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে সম্মান দিতে না পারলে আপনাদেরও কেউ সম্মান করবে না। গ্রামীণ ব্যাংককে ইউনূসের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না, যাবে না। কারণ, গ্রামীণ ব্যাংক আপনাদের হাতে গেলে এই ব্যাংকও দেউলিয়া হয়ে যাবে।’
খালেদা জিয়া বলেন, সব ধর্মের মানুষের দেশ বাংলাদেশ। এখানে ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ মুসলমান। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননাকারী নাস্তিক-ব্লগারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় হেফাজতে ইসলাম প্রতিবাদ করেছিল। হেফাজতের কর্মসূচির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই নিরস্ত্র লোকদের ওপর রাতের অন্ধকারে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অথচ এ ব্যাপারে কোনো সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরাই কোরআন পুড়িয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, বিডিআরের ঘটনায় ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ বিদ্রোহীদের ঠেকানোর জন্য সরকার একটি গুলিও ব্যবহার করেনি। তিনি বলেন, ‘এখন ঘরে-বাইরে কেউ নিরাপদ নয়। সম্প্রতি ঘরে ঢুকে এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়েছে। এই সরকারের আমলে সাংবাদিকরাও নিরাপদ নয়। সাগর-রুনিসহ এ পর্যন্ত ১৮ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সেক্টরের দুর্নীতি নিয়ে সাগর-রুনির কাছে অনেক তথ্য ছিল। এ জন্য তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে বলে তাঁদের হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে না। কিন্তু পাপ কোনো দিন চাপা থাকবে না। সব তথ্য আমাদের কাছে আছে, সময়মতো তথ্য ফাঁস করা হবে এবং এর বিচার করা হবে।’
খুলনার জনসভার উদ্দেশে গত শনিবার ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে খালেদা জিয়া যশোর সার্কিট হাউসে ওঠেন। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে তিনি যশোর থেকে খুলনার পথে রওনা দেন। দুপুর সোয়া ২টার দিকে খুলনার সার্কিট হাউসে পৌঁছেন। মধ্যাহ্নভোজ সেরে বিএনপি নেত্রী ৩টা ৫৫ মিনিটে মঞ্চে উপস্থিত হলে লক্ষাধিক মানুষ করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোট প্রার্থীদের জয়-জয়কারে মানুষের ব্যাপক উৎসাহে এ জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয় এবং সার্কিট হাউস মাঠ কানায়-কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। আশপাশের এলাকায়ও নামে মানুষের ঢল।
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা আগের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন জেলায় জনসভা করছেন। এরই মধ্যে তিনি নরসিংদী, রংপুর ও রাজশাহীতে জনসভা করেছেন। খুলনায় বিরোধীদলীয় নেতার এটি তৃতীয় জনসভা। এর আগে তিনি ২০১১ সালে ২৭ নভেম্বর রোডমার্চ উপলক্ষে সার্কিট হাউস মাঠে এবং ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল খুলনার শিববাড়ী মোড়ে তিনি জনসভা করেন।
Category: 1stpage, দেশের খবর, শীর্ষ সংবাদ