মানবতাবিরোধী অপরাধে সাকা চৌধুরীকে ফাঁসি দিল আদালত
ইউরোবিডি২৪নিউজঃ মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ মঙ্গলবার এ আদেশ দেন।
বিএনপির কোনো নেতার বিরুদ্ধে এটাই এ ধরনের মামলায় প্রথম রায়। এর আগে সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে জামায়াতের ছয়জন নেতার বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হয়েছে।
সাকা চৌধুরীর মামলায় রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের তৃতীয় মামলার রায় ঘোষণা করলেন। আর দুই ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে এটি সপ্তম রায়।
প্রমানিত অভিযোগ গুলো হল:
অভিযোগ নং ২: ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যরা গহিরা গ্রামে হিন্দু অধ্যুষিত পাড়ায় অভিযান চালিয়ে হিন্দু ডাক্তার মাখন লাল শর্মার বাড়িতে জড়ো করা হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
অভিযোগ নং ৩: ১৩ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা গহিরা শ্রী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে ব্রাশফায়ার করে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজে তাকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
অভিযোগ নং ৪: ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত জগত্মল্লপাড়ায় অভিযান চালান। এ সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দুই সহযোগীর আহবানে সেখানকার হিন্দু নর-নারীরা কিরণ বিকাশ চৌধুরীর বাড়ির আঙিনায় জড়ো হয়। সেখানে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে ৩২ নারী-পুরুষ মারা যান।
অভিযোগ নং ৫: ১৩ এপ্রিল বেলা একটার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার অনুসারীদের নিয়ে চট্টগ্রাম জেলার রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে হামলা চালান। সেনা সদস্যরা বণিকপাড়ায় প্রবেশ করে ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে অভিযান চালিয়ে নেপাল চন্দ্র ধর, মনীন্দ্র লাল ধর, উপেন্দ্র লাল ধর ও অনিল বরণ ধরকে গুলি করে। এতে প্রথম ৩ জন শহীদ ও শেষের জন আহত হন। হত্যাকাণ্ড শেষে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী তাদের অনুসারী ও পাকিস্তানি সৈন্যদের সুলতানপুর গ্রাম ত্যাগ করেন।
অভিযোগ নং ৬: ১৩ এপ্রিল বিকেল ৪টায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ক্ষিতীশ মহাজনের বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে শান্তি মিটিংয়ের নামে হিন্দু নর-নারীদের একত্রিত করে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রাশফায়ারে হত্যা করে।
অভিযোগ নং ৭: ১৪ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাউজান পৌরসভার সতীশ চন্দ্র পালিতের বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং তার লাশ কাঁথাকাপড় দিয়ে মুড়িয়ে তাতে পাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলে।
অভিযোগ নং ৮: ১৭ এপ্রিল সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরসহ তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য প্রাইভেটকারযোগে চট্টগ্রামের রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসছিলেন। পথে হাটহাজারী থানার খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি তিন রাস্তার মোড়ে পৌঁছামাত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা শেখ মোজাফফর আহম্মেদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে স্থানীয় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
অভিযোগ নং ১৭: ৫ জুলাই সন্ধ্যা রাতে চট্টগ্রাম জেলার কোতোয়ালি থানার হাজারী লেনের জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পোড়োবাড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গুডসহিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মেজর গজনফরের নেতৃত্বে ঘণ্টা দেড়েক তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। পরে ওইদিন রাত ১১ থেকে ১২টায় নিজাম উদ্দিন ও সিরাজকে চট্টগ্রাম কারাগারে নিয়ে গিয়ে কারারুদ্ধ করা হয়। সেখানে তারা দেশ স্বাধীন হওয়ায় আগ পর্যন্ত বন্দী ছিলেন।
অভিযোগ নং ১৮: জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা চট্টগ্রাম জেলার চান্দগাঁও থানার মোহারা গ্রামে আব্দুল মোতালেব চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে তারা সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করেন। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়িতে নিয়ে তাকে গুডসহিলে টর্চার সেলে নেওয়া হয়। বাড়ির বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে থাকা সাকা চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় সালেহউদ্দিনকে উদ্দেশ করে ফজলুল কাদের চৌধুরী জানতে চান, তিনি সালেহউদ্দিন কিনা। এ কথা বলতে বলতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে সালেহউদ্দিনের বাম গালে সজোরে একটি চড় মারেন।
প্রমাণিত হয়নি:
অভিযোগ নং ১: ১৯৭১ সালের ৪ বা ৫ এপ্রিল রাত ৯টার পর মতিলাল চৌধুরী, অরুণ চৌধুরী, যোগেশ চন্দ্র দে, পরিতোষ দাসরা একত্রিত হয় শহীদ মতিলাল চৌধুরীর চট্টগ্রাম শহরের রামজন লেনের বাসভবনে। সেখান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যের সহায়তায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী সোবহান ছয়জনকে অপহরণ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাসভবন গুডসহিলে নিয়ে যান। সেই ৬ ব্যক্তির আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। যা থেকে নিশ্চিত ধরে নেওয়া যায় যে, তাদের সেখানেই হত্যা করা হয়েছে।
অভিযোগ নং ১০: ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানিরা সাকা চৌধুরীর সঙ্গে ডাবুয়া গ্রামে মানিক ধরের বাড়িতে এসে তার জিপ গাড়ি ও ধান ভাঙ্গার কল লুট করে নিয়ে যায়। মানিক ধর সাকা চৌধুরীসহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন।
অভিযোগ নং ১১: ২০ এপ্রিল সকালবেলা কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে তাদের অনুসারী এবং পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী থানার হিন্দু অধ্যুষিত শাকপুরা গ্রামে অভিযান চালিয়ে হিন্দুদের হত্যা করে।
অভিযোগ নং ১২: ৫ মে সকাল সাড়ে ১০টায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাউজান থানার জ্যোতিমল্ল গ্রামে গুলি করে বিজয় কৃষ্ণ চৌধুরী রাখাল, বিভূতি ভূষণ চৌধুরী, হীরেন্দ্র লাল চৌধুরীকে হত্যা করে।
অভিযোগ নং ১৪: ২০ মে বিকেল ৪টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার পথেরহাটের কর্তার দীঘির পাড়ে হানিফকে আটক করে গুডসহিল নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে এক হাজার টাকা মুক্তিপণ দিতে না কারণে হানিফকে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ নং ১৯: ২৭ জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে আটটায় হাটহাজারীর নেয়ামত আলী রোডের সাহেব মিয়ার বাড়ি (রজমান টেন্ডলের বাড়ি) ঘেরাও করে তার দু’ছেলে নুর মোহাম্মদ ও নুরুল আলমকে অপহরণ করা হয়। এরপর রশি দিয়ে বেঁধে গুডসহিলে টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের অপর ভাই মাহবুব আলমের সন্ধান পান। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নুর মোহাম্মদ ও নুরুল আলমকে ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে গুডসহিলের নির্যাতন কেন্দ্রে থেকে ছেড়ে দেন।
অভিযোগ নং ২০: ২৭ অথবা ২৮ জুলাই বিকেল ৩ থেকে ৪টায় রাজাকারবাহিনী আকলাচ মিয়াকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাকে গুডসহিলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। সেখানে তার মৃত্যু ঘটে।
অভিযোগ নং ২৩: ২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক সোয়া ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মুসলিম ছাত্র পরিষদের সভাপতি ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের আলশামস কমান্ডার হামিদুল কবির চৌধুরী খোকা, মাহবুব, সৈয়দ ওয়াহিদুর আলম গং চট্টগ্রাম জেলার কোতোয়ালি থানার ৪০ আব্দুস সাত্তার রোড এলাকার এম সলিমুল্লাহর একজন হিন্দু কর্মচারীকে মিথ্যা এবং বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে মারধর করতে থাকেন। তাদের অভিযোগ হলো ওই হিন্দু কর্মচারী বিহারিদের ঘরে অগ্নিসংযোগ করেছেন। এম সলিমুল্লাহ এতে বাধা দিলে তাকে গুডসহিলে নির্যাতন সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সারারাত নির্যাতন শেষে তার আত্মীয়দের অনুরোধে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
ট্রাইব্যুনাল আলোচনা করেননি ৯, ১৩, ১৫, ১৬, ২১ ও ২২ নম্বর অভিযোগে।
Category: 1stpage, Scroll_Head_Line, দেশের খবর, প্রচ্ছদ, রাজনীতি, শীর্ষ সংবাদ