• ১৯ অগ্রহায়ণ ,১৪৩১,03 Dec ,2024
  • ব্রেকিং নিউজ : বাংলাদেশের রিকশাচিত্র পেল ইউনেস্কোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি

১২ ডিসেম্বর ২০১৩ রাত ১০টা এক মিনিটে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

| ডিসেম্বর 10, 2013 | 0 Comments

ইউরোবিডি২৪নিউজঃ ১২ ডিসেম্বর ২০১৩। রাত ১০টা এক মিনিট। বাংলাদেশের ৪৩তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রথম রায় কার্যকর হলো।

মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা ও ধর্ষণের দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার। নিজের কর্মের জন্য একাত্তরে তিনি ‘কসাই কাদের’ নামে পরিচিতি পান।

সরকারি ও কারাগার সূত্র জানায়,  বৃহস্পতিবার রাত ১০টা এক মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মিত স্থায়ী ফাঁসির মঞ্চে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। দণ্ড কার্যকর করতে সহায়তাকারী জল্লাদের প্রধান ছিলেন শাহজাহান ভুঁইয়া। উপস্থিত ছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কারা মহাপরিদর্শক মাঈন উদ্দিন খন্দকার, উপ-কারা মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার, ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শেখ ইউসুফ হারুন, জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী, কারাধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান, ঢাকার সিভিল সার্জন আবদুল মালেক, কারা চিকিৎসক রথীন্দ্রনাথ শম্ভু প্রমুখ।

শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, রাত ১০টা এক মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করে তাঁকে ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখা হয়। চারজন জল্লাদ তাঁর (কাদের মোল্লা) ফাঁসি কার্যকর করেন। রাতেই অ্যাম্বুলেন্সে করে পুলিশি পাহারায় লাশ ফরিদপুরে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।

সন্ধ্যায় কারাগারে কাদের মোল্লার সঙ্গে শেষ দেখা করার পর তাঁর বড় ছেলে হাসান জামিল বলেন, বাবার ইচ্ছা, ফরিদপুরে (সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ) গ্রামের বাড়িতে যেন তাঁকে কবর দেওয়া হয়।

কারাগার সূত্র জানিয়েছে, ফাঁসি দেওয়ার প্রায় ২০ মিনিট পর ১০টা ২১ মিনিটে তাঁকে নামানো হয়। এরপর কিছু প্রক্রিয়া শেষে কারাগারের দুজন চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এর আগে রাত নয়টার দিকে কাদের মোল্লাকে গোসল করানো হয়। সাড়ে নয়টায় তিনি নামাজ আদায় করেন। ১৫ মিনিট পর তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। নয়টা ৫৫ মিনিটে কারা জামে মসজিদের ইমাম মনির হোসেন তাঁকে তওবা পড়ান। এরপর ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয়। প্রথা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক তাঁর হাতে রাখা একটি লাল রুমাল মাটিতে ফেললে প্রধান জল্লাদ শাহজাহান ভুঁইয়া ফাঁসির মঞ্চের লিভার (লোহার তৈরি বিশেষ হাতল) টেনে দেন। এতে পায়ের তলা থেকে কাঠ সরে ফাঁসি কার্যকর হয়।

কারাগারের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এর আগে বিকেল সোয়া চারটায় দিকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজের আদেশ কারা কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছায়। এর পরপরই দুজন ম্যাজিস্ট্রেট কাদের মোল্লার কাছে যান। কাদের মোল্লা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না জানতে চাইলে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটদের জানান, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না।

রায় কার্যকর উপলক্ষে সন্ধ্যা থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য নিরাপত্তাব্যূহ গড়ে তোলেন। সঙ্গে ছিল পুলিশের সাঁজোয়া যান। কারাগারের বাইরে ফাঁসির খবর জানতে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের শতাধিক সাংবাদিক। রাত পৌনে ১২টার দিকে কারাগারের সামনে স্থানীয় লোকজন সাজা কার্যকরকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ মিছিল করেন। রাত ১১টার পর কাদের মোল্লার মরদেহবাহী দুটি অ্যাম্বুলেন্স ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৪টি গাড়ির বহর ফরিদপুরের দিকে রওনা হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রায় পৌনে চার বছরের আইনি লড়াই শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে একাত্তরের নির্মমতার বিচারহীনতা থেকে মুক্তি পেল জাতি। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কারও সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হলো।

 মঙ্গলবার সন্ধ্যায় (১০ ডিসেম্বর) কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের ঘোষণা দিয়ে সরকারের সংবাদ সম্মেলন এবং শেষ মুহূর্তে ফাঁসির কার্যক্রমে নাটকীয় স্থগিতাদেশের পর গতকাল রাতে আর কোনো আগাম ঘোষণা দেওয়া হয়নি। তবে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে স্ত্রী সানোয়ার জাহান, ছেলে হাসান জামিলসহ পরিবারের ১০ সদস্য কারাগারে গিয়ে কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখা করেন।

এর আগে দুপুর ১২টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) দুটি আবেদন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় খারিজ করে দেন।

কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে এবার বিশ্বের পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি উচ্চারিত হবে বাংলাদেশের নাম, যারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো দুরূহ কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্সের মতো রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জার্মান নাৎসি বাহিনীর বিচার করে ন্যুরেমবার্গের ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে (আইএমটি)। ন্যুরেমবার্গ বিচারে অভিযুক্ত ২২ জনের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা হয় ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবর। মাত্র ১৫ দিন পর ১৬ অক্টোবর ১০ যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বাকি দুই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তের একজন ছিলেন পলাতক, একজন ফাঁসি এড়াতে আগের দিন রাতে আত্মহত্যা করেন। ন্যুরেমবার্গের পাশাপাশি টোকিও ট্রাইব্যুনালে বিচার হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তি জাপানি নেতাদের, যেখানে ২৮ জনের মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর তাঁদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

বাংলাদেশে বিচারের শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামীসহ একটি পক্ষ বিচার-প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছে। বিশ্বের যেসব দেশে এখন আর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না, সেসব দেশও সর্বোচ্চ সাজার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানিয়ে আসছিল।

ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কার্যরত জাতিসংঘের সাহায্যে গঠিত হাইব্রিড ট্রাইব্যুনাল বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) বিচার নিয়েও সমালোচনা আছে। ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়ালে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আপিলেরও সুযোগ পাননি, রায় ঘোষণার পরই দণ্ড কার্যকর হয়েছে। প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগও তাঁদের ছিল না।

কারা কর্তৃপক্ষের জরুরি চিঠি পেয়ে গত মঙ্গলবার রাতেও কাদের মোল্লার সঙ্গে তাঁর পরিবারের ২৩ সদস্য দেখা করেছিলেন। ওই দিন সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন প্রধান আইনজীবী আবদুর রাজ্জাকসহ কয়েকজন আইনজীবী।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের সঙ্গে এ দেশের তরুণ প্রজন্মের নাম জড়িয়ে থাকবে চিরদিন। একাত্তরে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে সাড়া জাগিয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসার এক বছর পর ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে সরকার বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করে। কিন্তু চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলে রায়ে অসন্তুষ্ট তরুণ প্রজন্ম রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারা দেশে তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষকে আপিলের সমান সুযোগ দিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে জাতীয় সংসদ। দুই পক্ষই শরণাপন্ন হয় সর্বোচ্চ আদালতের। ছয় মাসের আইনি লড়াই শেষে ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ দেন। এরও প্রায় তিন মাস পর ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের ৭৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ৮ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনই তা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এর পরই সরকার সাজা কার্যকরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।

 রাতে কারাগারে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে শাহবাগে তিন দিন থেকে অবস্থান নেওয়া গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা স্বস্তি প্রকাশ করেন। দণ্ড কার্যকরের বিষয়টি মাইকে ঘোষণার পর আলোর মিছিল করেন তাঁরা।

নিজস্ব আইনে ও দেশীয় আদালতে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করায় বাংলাদেশ ইতিহাস হয়ে থাকবে। কম্বোডিয়াকে এ বিচারের জন্য ৩৭ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, কিন্তু তাদের জাতিসংঘের সাহায্য নিতে হয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সময়ে কম্বোডিয়ায় ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৯৭ সালে হাইব্রিড ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ওই ট্রাইব্যুনাল ২০১০ সালে প্রথম রায় দেন, ২০১২ সালে কম্বোডিয়ার সুপ্রিম কোর্ট তা চূড়ান্ত করেন।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় ৩৯ বছর পর। অন্য কোনো রাষ্ট্র বা জাতিসংঘের সাহায্য ছাড়াই মাত্র পৌনে চার বছরের মাথায় একটি মামলার বিচার শেষ করে দণ্ড কার্যকর হয়েছে—বিশ্বে এমন দৃষ্টান্ত খুব একটা নেই।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার

হযরত আলী লস্করসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা ও মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে আপিল বিভাগের ফাঁসির আদেশ

বিচার শুরু

২০১২ সালের ২৮ মে বিচার শুরু। গত ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-২

ফাঁসির দাবি

কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তরুণদের ডাকে শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ

আইন সংশোধন

২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সমান সুযোগ রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধন

রায় পুনর্বিবেচনা

১০ ডিসেম্বর রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন। ১২ ডিসেম্বর খারিজ

ফাঁসি কার্যকর

১২.১২.২০১৩

রাত ১০.০১ মি.

Category: 1stpage, Scroll_Head_Line, দেশের খবর, প্রচ্ছদ, ব্রেকিং নিউজ, শীর্ষ সংবাদ

About the Author ()

Leave a Reply