*গল্পঃ ‘শেষ বিকেলের চিঠি’ Writer: Shadman Habib Shuvo
*গল্পঃ ‘শেষ বিকেলের চিঠি’
Writer: Shadman Habib Shuvo
“যদি আজ বিকেলের ডাকে
তার কোনো চিঠি পাই ?
যদি সে নিজেই এসে থাকে?
যদি তার এত কাল পরে মনে হয়
– দেরি হোক, যায়নি সময়!”
৩০ অক্টোবর, ২০৩০
লস এঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া।
I BELIEVE IN MIRACLE.
রহস্যময় এ জগতে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে, যা ঘটবার কথা নয়; কিন্তু ঘটে যায়! যুক্তি দিয়ে যার কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়না। তা না হলে দীর্ঘ ষোল বছর পর ঠিক এই দিনে, সুদূর আমেরিকার অচেনা এ নগরীতেই কেন ওর সাথে আবার দেখা হবে ? Isn’t it miracle ?
এ পর্যন্ত লিখে ডায়েরীটা বন্ধ করলো শাহেদ। এক কাপ কফি খাওয়া দরকার। জাঁকিয়ে শীত নেমেছে শহরে। গত কয়েক বছরে নাকি এরকম হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডা পড়েনি এখানে। কানাডা ছেড়ে এখানে আসাটাই বিরাট বোকামি হয়েছে। পরক্ষনেই ওর মনে হলো – কে জানে, কানাডায় থাকলে হয়তো এতকাল পর দৈব চক্রে জেরিনের সাথে এভাবে দেখাটা হতো না! কফির মগটা কিচেন থেকে নিয়ে রিডিং রূমে ঢুকেই আবার লিখতে বসলো ।
“ আজ বিকেলটা ছিল অন্যরকম । বহুদিন পর কী মনে করে রকি বীচের একদম শেষ প্রান্তে নতুন যে ZOO- টা চালু হয়েছে, তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম এত কাছ দিয়েই যাচ্ছি যখন, তখন না হয় একটু ঢুঁ মেরেই যাই । টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি, আর ঠিক তখনি দেখলাম ওকে ! কালো রঙের ড্রেসে। চোখে চোখ পড়তেই যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো জেরিন । কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হলো- গোটা পৃথিবীটা যেন থমকে গেলো। সেই মায়াভরা দুটি চোখ, সেই অতি পরিচিত ঠোঁট, সেই লাবণ্যময় মায়াকাড়া চেহারা – সবই যেন ঠিক আগের মতো ! কিন্তু কোথায় যেন খানিকটা গরমিল!
রবি ঠাকুরের বহুল পঠিত সেই কবিতার মতো-
মনে হলো- কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চারদিকে,
যে দূরত্ব সর্ষে-ক্ষেতের শেষ সীমানায় শালবনের নীলাঞ্জনে ।
থমকে গেলো আমার সমস্ত মনটা,
চেনা মানুষটাকে দেখলাম অচেনার গাম্ভীর্যে !
বলার অপেক্ষা রাখেনা, এতকাল পরে ভিনদেশের মাটিতে আমাদের দুজনের এই হঠাত দেখায় কিছুটা অপ্রস্তুত দুজনই। বিস্ময় আর অস্বস্তিকে পাশ কাটিয়ে আমি-ই এগিয়ে গেলাম প্রথম। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে সহজ হবার চেষ্টা করলো জেরিন। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখাও ফুটে উঠলো যেন। কিন্তু সেই হাসিতে আগের মতো দুষ্টুমির ছাপ নেই।
– ‘শাহেদ’- নামটা মনে আছে তো ?
একগাল হেসে মাথা ঝাঁকাল জেরিন। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল যেন। আন্দাজ করলাম- আমার টিপ্পনি কেটে কথা বলার স্বভাবটা যে আর গেলনা; সেটাই বোধ হয় বলতে চাইলো। ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করেই ফের জিজ্ঞেস করলাম-
– তারপর ? কেমন আছো ? এখানে হঠাত এভাবে এত বছর পর তোমার সাথে আবার দেখা হবে ভাবিনি।
– আমিও না। জিতুকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ও হঠাত জেদ ধরলো এখানে আসার জন্য। তাই …
– জিতু … ?
– আমার ছেলে । ঐ যে ও-দিকটায়। অ্যাই জিতু … অ্যাই …
কী আশ্চর্য ! ছেলেটা দেখতে জেরিনের মতো হয়েছে । সেই কপাল, সেই চোখ, সেই ভ্রূ। আমার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটার প্রতি হঠাত গভীর মমতা অনুভব করতে লাগলাম। বারবার মনে হতে লাগলো- ওর নাম জিতু নয়। ওর নাম শান! আনমনে আমি ওর মাথায় হাত বুলালাম। তারপর ঘোরের মধ্যেই জেরিনকে বলে বসলাম-
– চলো… কোথাও বসি ? অবশ্য… যদি তোমার আপত্তি না থাকে ?
বলেই মনে হলো- বেচারীকে বিব্রতকর একটা পরিস্থিতিতে ঠেলে দিলাম না তো আবার! হয়তো ওর স্বামীও এসেছে সাথে। হয়তো আশে পাশেই কোথাও আছে, এখনি চলে আসবে। আমাকে স্বস্তি দিয়ে জেরিন বেশ স্বাভাবিক ভাবেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করলো। রাস্তার ওপাশের কফি শপে গিয়ে বসলাম আমরা তিনজন। বয় এসে জিতুর জন্য মিল্ক শেক আর আমাদের দুজনের জন্য দুটি ব্ল্যাক কফির অর্ডার নিয়ে গেল।
কফিশপের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। লালচে রঙের মেঘ আকাশে। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলাচ্ছে । এই লাল, এই হাল্কা হলুদ, আবার চোখের নিমিষেই খয়েরি ! রঙের কারিগর কি আজ কোনো কারণে বিভ্রান্ত ?
নীরবতা ভেঙ্গে জেরিনই বলে উঠলো–
– তারপর … তোমার কি খবর ? এখানে কতদিন ধরে ?
– লস এঞ্জেলস এসেছি মাস তিনেক হলো। এর আগে কানাডায় ছিলাম প্রায় দশ বছর। সেই যে পোস্ট- গ্র্যাজুয়েশনের জন্য এসেছিলাম, তারপর থেকেই তো বাইরেই। মাঝে অবশ্য বছর দুয়েক দেশে ছিলাম, পারিবারিক কিছু কারণে।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে জেরিন জিজ্ঞেস করলো –
– তোমার ফ্যামিলি… আই মিন… বৌ –বাচ্চারা কোথায় ?
প্রশ্নটা শুনে হাসলাম ওর দিকে তাকিয়ে। যে উদ্দেশ্যে হাসিটা দেয়া, তা শতভাগ সফল। ও বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি কিছু বললাম না। কফি পৌঁছে গেছে টেবিলে। ধূমায়িত সেই কফির কাপে চুমুক দিয়ে প্রসঙ্গ বদলালাম।
– তোমার ছেলেটা তো একদম তোমার মতো হয়েছে দেখতে । ওর বাবার কিছুই পায়নি নাকি ?
– নাহ । তেমন কিছুই পায়নি । অবশ্য আমি চাইও না, ও ওর বাবার কিছু পাক ।
কথাটা বলার সময় জেরিনের কণ্ঠস্বর যেন খানিকটা কেঁপে উঠলো। ওর দৃষ্টি- আকাশের ঐ লালচে রঙের মেঘের দিকে। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতেই মুখ ফসকে প্রশ্নটা করে ফেললাম-
– Aren’t you happy, Zarin ?
কোনো উত্তর দিলো না । নিশ্চুপ রইলো। পিনপতন নীরবতা। মনে হচ্ছিল- এক একটা মুহূর্ত যেন ফেলে আসা এক একটা বছরের মতোই দীর্ঘ। আইনস্টাইনের- relativity of time !
নীরবতা ভেঙে , ও হঠাত বলতে শুরু করলোঃ
– বিয়েটা করেছিলাম বাবা-মার পছন্দেই। আমেরিকার গ্রিন কার্ড হোল্ডার পাত্র। পেশায় ডাক্তার। ব্যস, বাবার ভীষণ পছন্দ হয়ে গেলো। আমিও আর আপত্তি করলাম না। বেশ ঘটা করেই বিয়েটা হয়। আর বিয়ের বছরখানেকের মাথায় এখানে চলে আসি।
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে থামল । আমি খুব মনোযোগ দিয়ে ওর চোখের দিকে তাকালাম। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেলো কবিগুরূর দুটি লাইন- ” প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”
পুরনো সেই দিনগুলির মতো, আমি সর্বনাশা ঐ চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করলাম। অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস পাবারই কথা। কিন্তু কী আশ্চর্য! আমি ঠিকই পড়তে পারছি! সরাসরি বলতে না চাইলেও আমি জেনে গেছি, তুমি সুখে নেই। একেবারেই নেই ! কিন্তু … এমনটা তো হবার কথা ছিলনা জেরিন ! শুধু তোমার সুখের জন্যই তো …..
নাহ! আমি আর কিছু ভাবতে পারছিনা।
– আবার মৃদুস্বরে বলতে শুরু করলো জেরিন…
– আসলে মনের মিল না থাকলে যা হয়। রাফাত আর আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের দুজন মানুষ। প্রথম প্রথম ভাবতাম, এগুলো বড় কোনো ব্যাপার না। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই ঠিক হয়নি। বরং ঐ অমিলের জায়গাগুলো পরে অনেক জটিলতা সৃষ্টি করলো। ততদিনে জিতু এই পৃথিবীতে চলে এসেছে। ছেলেটাকে ঘিরে জীবনটা নতুন করে সাজাতে শুরু করলাম। রাফাতের সাথে এক ছাদের নিচে না থাকলেও, আমি আমার ছেলেকে নিয়ে বেশ ভালো আছি। রকি বীচের কাছে নর্থ স্ট্রীট রোডে, সান ভ্যালীতে একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে বেশ শান্তিতেই আছি। so… I am happy enough …
যন্ত্রের মতো কথাগুলো বলে থামল জেরিন। আমার অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে- কিছুই বলা হলো না। তারপর আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা। দৃষ্টি এবার আকাশের দিকে দুজনেরই।
লক্ষ্য করলাম- ওর ফোনটা ক্রমাগত বেজেই যাচ্ছে, অথচ সেদিকে ওর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। শেষ পর্যন্ত আমিই ওকে বললাম- ফোনটা বাজছে জেরিন । টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে বললো – আমাকে এখন যেতে হবে। ভালো থেকো। আমি কিছুই বললাম না; কিংবা কী বলবো তা বুঝতে পারার আগেই ও বিদায় নিল। আমি কেবলই তাকিয়ে রইলাম … আকাশের ঐ লালচে মেঘের দিকে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
লেখার ডায়েরিটা বন্ধ করে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলো শাহেদ। নিঃশব্দে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। সফেদ তুলার মতো খন্ড খণ্ড তুষার পড়ছে আকাশ থেকে। এখানকার তুষারপাত দেখলেই বাংলাদেশের বর্ষাকালের ঝুম বৃষ্টির কথা মনে পড়ে যায়। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দটা- অনেকদিন শোনা হয়না! কে জানে, আর কখনো শোনা হবে কিনা! মনটা ভীষণ ছটফট করে দেশের জন্য। বিশেষ করে যখন মনের পর্দায় ভেসে ওঠে মা’র মুখটা! শাহেদের সিদ্ধান্তে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে মানুষটা। একটামাত্র ছেলে তাঁর, অথচ ঘর সংসার না করে সারাটা জীবন বিদেশে একা একা কাটিয়ে দিবে- এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি তিনি।
শাহেদ আর কিছু ভাবতে পারছেনা। মাথার ভেতর এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে তার। চশমাটা খুলে মাফলারের এক কোনা দিয়ে গ্লাসটা পরিষ্কার করলো। তারপর একটা সিগারেট ধরালো। বুকের ভেতর জমাট বেঁধে থাকা কষ্ট গুলোকে সিগারেটের ধোঁয়ার মাধ্যমে বাইরে বের করে দেয়ার চেষ্টা। অত্যন্ত ছেলেমানুষি চেষ্টা!
………………………………………………………………………………………………………………………………….
৪ নভেম্বর, ২০৩০
জেরিন,
কখনো ভাবিনি এতকাল পর আবার আমাদের দেখা হবে। তাও আবার সাত সাগর তের নদীর ওপারে এই দূর প্রবাসে! নিয়তির সুতো ধরে যিনি প্রতিনিয়ত কলকাঠি নাড়ছেন, তাঁর চিত্রনাট্যে হয়তো এমনটাই ছিল- কে জানে! হয়তো এ জন্যই বলা হয়, সবই ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। আমরা সবাই কেবল তাঁর ইশারায় নাচতে থাকা এক একটি পুতুল!
সেদিন যখন তোমায় দেখি, ভেবেছিলাম তুমি বুঝি সেই আগের মতোই রয়েছো; একটুও বদলাও নেই। তোমার সেই চাহনি, সেই কণ্ঠস্বর- সব যেন আগের মতোই। কিন্তু আমার ভুলটা ভাঙলো, যখন তুমি তোমার জীবনের গল্পটা বলতে শুরূ করলে। তুমি কথা বলছিলে, আর বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলে। আমি জানিনা লালচে রঙের মেঘের ভেলায় ভেসে তুমি ১৬ বছর আগে ফিরে যাচ্ছিলে কিনা। কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, তুমি আর আগের মতো নেই জেরিন। একেবারেই বদলে গিয়েছ তুমি। অবশ্য বদলাবারই তো কথা। ১৬ বছর- অনেক দীর্ঘ সময়। অনেক !
অনেক কথা বলার ছিল। অনেক প্রশ্নই করার ছিল। ভেবে রেখেছিলাম, যদি কখনো আবার এ জীবনে চলার পথে দেখা হয়ে যায়, তাহলে প্রশ্নগুলো করবার সুযোগ হাতছাড়া করবোনা। অথচ দেখো .. দেখা হবার পর কিছুই বলতে পারলাম না! কেবল মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকের মতো তোমার দিকে চেয়ে তোমার গল্পটা শুনলাম। আর শুনতে শুনতেই সময়টা কখন যে ফুরিয়ে গেলো, টের পেলাম না।
তুমি সেদিন আমায় একটা প্রশ্ন করেছিলে জেরিন, সেটারও কোনো উত্তর দেয়া হয়নি আর। আসলে একা থাকতে থাকতে গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাসটাও হারিয়ে ফেলেছি বোধ হয়। তাই শুধু হেসেছিলাম; তুমি জিজ্ঞেস করার পর। আমার মনে হয় তুমি তোমার প্রশ্নের জবাবটা এতক্ষণে পেয়ে গেছো। হ্যা … ‘একা’। আমি একদমই একা। বিয়েটা আর করা হয়নি। না, তুমি এটা ভেবোনা যে- রোমিও, দেবদাস কিংবা মজনু,ফরহাদের মতো প্রেমিক-পুরুষ হিসেবে প্রেমিকার জন্য আমার এই মহান আত্মত্যাগ। প্রেমের ইতিহাসে নাম লেখাবার ইচ্ছা আমার কোনো কালেই ছিলনা। আসলে সত্যি বলতে- আমি আর কখনোই কাউকে TRUST করতে পারতাম না। যেকোনো সম্পর্কের সবচেয়ে বড় ভিত্তি হচ্ছে- বিশ্বাস। তুমি আমার বিশ্বাসের সেই জায়গাটা এতটাই দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলে যে, আমার পক্ষে নতুন করে কারো সাথে ভালবাসার সম্পর্কে জড়ানো সম্ভব ছিলনা। আর বিয়ে করে বৌকে যদি ভালবাসতেই না পারি, তবে কেন মিছেমিছে বিবাহ-বন্ধনে জড়ানো ? কেনই বা প্রতিদিন মিথ্যে ভালবাসার অভিনয় করে যাওয়া ? বিয়ে না করে অন্তত আর যাই হোক, নিজের সাথে প্রতারণা তো আর করা হলনা। এইবা কম কি ?
তবে হ্যা, অস্বীকার করবোনা- এই ব্যস্ত জীবনে মাঝে মাঝে একটা কাঁধের খুব দরকার হয়, যেখানে মাথা রেখে নিজের সব চিন্তা ভাবনা দূর করে একটু স্বস্তি পাওয়া যায়। একটা হাতের খুব দরকার হয়, যে দুঃসময়ে আমার হাত আলতো করে চেপে ধরবে। যেন নীরবে বলা – “আমি আছি” । এক জোড়া চোখের দরকার হয়- যে চোখে আমাকে দেখতে পাবো। যে চোখে লেখা থাকবে- “ভালবাসি” ।
তোমার মনে আছে জেরিন, আমি প্রায় রাতেই বেসুরো গলায় গান শোনাতাম তোমাকে ? ঐ যে, তাহসানের ঐ গানটার কথা মনে আছে তোমার ? – “আমি আবার আরেকটাবার তোমার প্রেমে পড়তে চাই”। আমি কিন্তু কখনো গান শিখিনি, গানের গলাও আমার ছিলনা। অথচ কেন জানি তোমাকে রাত-দুপুরে গান শোনাবার সময় কখনো আমার মাঝে কোনো দ্বিধা কাজ করতোনা । মনে আছে, একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত আমরা প্রায়ই একসাথে গাইতাম ? আমার কখনোই গানের লাইনগুলো মনে থাকতো না। বারবার ভুল করতাম; আর তুমি বারবারই আমায় শুধরে দিতে। তোমার গলায় গানটা মানাতও চমৎকার ! ওহ! এ কথাটা আগে কখনো বলা হয়নি, না ? মানুষ বেশিরভাগ সময় প্রয়োজনীয় কথাটি বলতেই ভুলে যায়। আচ্ছা, তুমি কি এখনো মাঝে মাঝে গুনগুন করে গানটা গাও ? আচ্ছা, আমরা কি আমাদের একটা জীবন একসাথে গান গাইতে গাইতেই পার করে দিতে পারতাম না ? খুব বেশি কী ক্ষতি হতো ?
আমার এখনো মনে পড়ে- প্রথম যেদিন আমরা একে অপরের হাত ধরেছিলাম, কি শক্ত করেই না ধরেছিলাম! যেন কখনোই কোনো শক্তি আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে না পারে। তোমার কি মনে আছে ? যতক্ষণ আমি তোমার সাথে থাকতাম তোমার হাত ধরে থাকতাম। আমার সামনে অন্য কেউ তোমার হাত ধরলে হিংসায় আমার সারা গা জ্বলে যেত! কী অদ্ভুত ছেলেমানুষি করতাম আমি, না ? এই নিয়ে তুমি চান্স পেলেই আমায় ক্ষেপাতে। কী চমৎকার একটা সময়-ই না পার করছিলাম আমরা! কেন হঠাত এমনটা করলে জেরিন ? কী দোষ ছিল আমার ? কেন হঠাত এমন জেদ করলা তুমি ?
একটা সম্পর্ক যখন গড়ে ওঠে, তাকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠে একটা স্বপ্ন। দিনে দিনে সম্পর্কটা যখন ঘনিষ্ঠ হয়, স্বপ্নটাও ডানা মেলে উড়তে শুরু করে কল্পনার আকাশে। সাময়িক অভিমানে কিংবা জেদের বশে- সেই স্বপ্নটা ভেঙে যেতে পারেনা, যাওয়া উচিত না। তুমি আমাদের সেই স্বপ্নটাকে খুন করেছো জেরিন! ঠিক কী কারণে এমনটা করেছিলে তা এখনো আমার কাছে একটা রহস্য! আমি অবশ্য কারণটা জানতে চেয়েছি বারবার। কিন্তু তুমি কখনোই প্রকৃত কারণটা বলোনি। বারবার ‘ফ্যামিলি’-কে ঢাল বানিয়েছো, দূরে সরে যাওয়ার জন্য। আচ্ছা, যদি এটাই একমাত্র কারণ হয়ে থাকে, তবে সেটা আমরা সম্পর্ক গড়ার শুরুতেই জানতাম; তাইনা ? প্রত্যেকটা রিলেশনেই কিন্তু একটা কমিটমেন্ট থাকে। আমার দুঃখটা কোথায় জানো ? তুমি কখনোই আমাদের সম্পর্কটার জন্য এতটুকু চেষ্টা করোনি! যদি তুমি একটাবার অন্তত চেষ্টা করতে, আর তারপর ব্যর্থ হতে- আমার কোনো কষ্ট থাকতো না। অন্তত নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতে পারতাম “ থাক, ও অন্তত চেষ্টা তো করছে ! ভাগ্যে নাই, কি আর করা ? ”
কী অসহ্য দিন কেটেছে আমার, কী ভীষণ দুঃসহ যন্ত্রণার এক একটা রাত! তুমি কখনোই তা কল্পনা করতে পারবেনা জেরিন। রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটেছে আমার। অপেক্ষা করেছি তোমার একটা কলের জন্য। ভেবেছি অন্তত বন্ধুর মতো এই সময়টায় আমার পাশে থাকবা ! এতটুকু সাপোর্ট কী তুমি আমায় দিতে পারতা না ? সেই সময় এক একটা মুহূর্ত যেন ছিল এক একটা যুগের মতো দীর্ঘ। এদিকে তখন আমার অনার্স ফাইনাল সামনে। যে সময়ে আমার সব বন্ধুরা, যার যার জীবনটাকে গুছিয়ে স্বপ্ন- পূরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে আমি পথ হারিয়ে হতাশার সমুদ্রে নিমজ্জিত। ওরা সবাই যখন জিজ্ঞেস করতো- আমি এড়িয়ে যেতাম। অনেকদিন আমি আমাদের ভাঙনের কথাটা গোপন রেখেছিলাম এই আশায়- হয়তো আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি নিশ্চয়ই আবার ফিরে আসবে। যেভাবে আগেও এসেছিলে!
যখন বুঝতে পারলাম, আর আসবেনা … নিজেকে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করলাম। তোমাকে ঘৃণা করতে চাইলাম। মন থেকে ঘৃণা করা ছাড়া ভুলবার বিকল্প কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কয়েকদিন বেশ ভালোই কাটলো। মনকে বোঝালাম, নিশ্চয়ই তুমি অন্য কোথাও সুখ খুঁজে নিয়েছো । তোমার মনোযোগ হয়তো অন্য কোথাও সরে গেছে। কিন্তু বেশিদিন ঘৃণা করতে পারলাম না। I wish I could hate you … but … I HATE TO HATE YOU! হয়তো মন থেকে তোমাকে ঘৃণা করতে পারলেই, ভালো হতো। সব ভুলে যেতে পারতাম। কে জানে, তাহলে আজ আমারও হয়তো জিতুর মতো একটা ছেলে থাকতো! যাকে নিয়ে প্রতিদিন বিকেলে পার্কে বেড়াতাম। হয়তো মায়াবতী একটা জীবনসঙ্গিনী থাকতো – যার সাথে জোছনা রাতে মন খুলে গল্প করতে পারতাম! কিন্তু না। আমি পারিনি তোমায় ঘৃণা করতে। কি করে পারবো বলো ? যাকে এতটা গভীরভাবে ভালবেসেছি, চাইলেই কি তাকে ঘৃণা করা যায়? … Being with you is the only way I could have a full and happy life …
পুরনো সেই দিনগুলোর কথা বারবার মনে পড়ে যায় জেরিন। তুমি যখন বললে- তুমি আর আমার নেই, আমি বিশ্বাস করিনি। কেন করিনি জানো ? ভালবাসা আর ঘৃণা দুটোই লেখা থাকে মানুষের চোখে। আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার চোখে আমার জন্য জমে থাকা ভালবাসা দেখেছি জেরিন। আমি এক জীবনে আমার জন্মদাত্রী বাদে আর কারো চোখে আমার জন্য এত গভীর মমতা দেখিনি । দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি, ভালবাসায় আর্দ্র সেই চোখ জোড়া আরেকবার দেখার জন্য। আমার অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে জেরিন। এত বছর পর, আবারো তোমার চোখে আমি ভালবাসা দেখেছি। তবে তা আমার জন্য নয়। তোমার সমস্ত ভালবাসা এখন শুধু তোমার ছেলেটার জন্য। সম্ভবত এই প্রথম হিংসায় আমার গা জ্বলে যায়নি !
জীবন চলার পথে তোমার সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা জানিনা। হয়তো আর কখনোই কথা হবেনা! দীর্ঘকাল ধরে বুকের গহীনে জমে থাকা কথাগুলো চিঠিতে লিখতে পেরে নিজেকে খানিকটা হালকা লাগছে। আমার জীবনে লেখা দীর্ঘতম চিঠিটা ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। ও হ্যা … একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখতে ভুলে গিয়েছি। চিঠির শুরুতেই এটা লেখা উচিত ছিল। Happy Birthday Zarin. শুভ জন্মদিন! তুমি যেখানেই থাকো, যেভাবেই থাকো, যার সাথেই থাকো- সুখে থাকো। ভালো থাকো। পরম করুনাময়ের করুনাধারা বর্ষিত হোক তোমার ওপর।
বিদায়-
তোমার সাহিত্যিক!
চিঠিটা ভাঁজ করে নীল রঙের একটি খামে ভরে বুক পকেটে রাখলো শাহেদ। এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে রকি বীচের পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতেই তার হঠাত মনে হল- চিঠিটা পাঠানো ঠিক হবেনা। কী লাভ পাঠিয়ে ? এই এতকাল পরেও পুরনো সেই স্মৃতিগুলো ও যেভাবে মনে রেখেছে, হয়তো জেরিনের সেভাবে মনে নেই। হয়তো এখন ওর কাছে অস্পষ্ট ধোঁয়ার মতো এসব স্মৃতি! কুয়াশায় ঢাকা। আর এটাই কি স্বাভাবিক না ? জেরিনের জীবনে এই ১৬ বছরে কতো কিছুই না ঘটেছে। বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে, ফুটফুটে একটা সন্তানের মা হয়েছে। শাহেদের মতো একাকী-নিঃসঙ্গ জীবন কাটেনি তার। নানান প্রতিকূলতার মাঝেও ছেলেটাকে নিয়ে নতুনভাবে জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছে সে। তবে কেন শুধু শুধু তাকে অতীতের ফেলে আসা সময়ের মুখোমুখি করা ? তাও আবার এতকাল পর ?! কোনো মানে হয় ?
# গোধূলি বেলা। বিকেলের সূর্যটা ডুবি ডুবি করছে। মায়াবী এক বিভ্রম সৃষ্টি করেছে যেন প্রকৃতি। চারদিক কী অসহ্য সুন্দর! সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। বীচে কিছুক্ষণ একাকী দাঁড়িয়ে রইলো শাহেদ। হঠাৎ বুকপকেট থেকে খামটা বের করে, কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেললো চিঠিটা। এরপর সব দলা পাকিয়ে, ছুঁড়ে ফেললো সমুদ্রের দিকে। ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সাদা কাগজের টুকরোগুলো ।
বাকী জীবনটার জন্যও সে কী তার সমস্ত অভিমান চিঠিটার মতোই সমুদ্রের মাঝে ছুঁড়ে ফেলতে পারলো ?
—– *** —-
Category: 1stpage, শিল্প-সাহিত্য