অনায়াসে ‘পাহাড়’ টপকাল বাংলাদেশ
খেলাধুলা: দুই ইনিংসের বিরতির সময় স্যাক্সটন ওভালের পটভূমি হয়ে দাঁড়িয়ে আবছায়া পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছিল প্রতীকী। স্কটল্যান্ড যেন ওই পাহাড় টপকানোর চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। ৩১৮! ৩১৮!!
পারবে বাংলাদেশ? স্কটিশ বোলিং এখানে নিছক নামেই প্রতিপক্ষ, আসল প্রতিপক্ষ তো ইতিহাস। বিশ্বকাপের এই শ্বাসরোধী চাপের ম্যাচে ইতিহাসকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারবে বাংলাদেশ?
দুই ইনিংসের বিরতির সময় ইতিহাস চোখ রাঙিয়ে বলছে—ওয়ানডেতে তিন শর বেশি রান তাড়া করে বাংলাদেশের জয়ের ঘটনা মাত্র দুটি। জিততে হলে ছাড়িয়ে যেতে হবে সে দুটিকেই। কী অবলীলায়ই না তা হয়ে গেল! সাকিব আল হাসান যখন ওয়ার্ডলকে থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে আছড়ে ফেলে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে গ্লাভস খুললেন, মনে হলো আরও ২০-৩০ রান বেশি করতে হলেও কোনো সমস্যা হতো না। তখনো তো ইনিংসের ১১ বল বাকি!
স্যাক্সটন ওভালে অস্থায়ী তাঁবুর নিচে প্রেসবক্স। স্কটল্যান্ড ইনিংসের সময় সদা তৎপর স্কোরারের কণ্ঠে একটু পর পরই ঝনঝন শব্দে রেকর্ড ‘ভাঙছে’। ভোররাতে উঠে টেলিভিশনের সামনে বসা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ও কি একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছিল না! ছক্কা মেরে কাইল কোয়েটজার সেঞ্চুরি করলেন। স্কটল্যান্ডের পক্ষে বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশ্বকাপে কোনো সহযোগী সদস্যদেশের ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংসটিও কোয়েটজারের হয়ে গেল। ইনিংসের ৩৩ বল বাকি থাকতে স্কোর ১৫৬। কী সর্বনাশ, যেভাবে বল ব্যাটে লাগছে, ডাবল সেঞ্চুরি-টেঞ্চুরি হয়ে যাবে না তো!
কোয়েটজারকে ১৫৬-তেই থামালেন নাসির। তবে শেষ ১০ ওভারে ৮৮ রান তুলে স্কটল্যান্ড যেখানে থামল, এর আগে কখনো সেখানে বাংলাদেশের পা পড়েনি। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানই ৯ উইকেটে ২৮৩ (ভারতের বিপক্ষে মিরপুরে)। এখানে এর চেয়েও ৩৬ রান বেশি করতে হবে, সেটিও ৯ উইকেট হাতে নিয়ে। ফিল্ডিংয়ের সময় কাঁধে চোট পেয়ে বেরিয়ে গেছেন এনামুল। তাতে যে তাঁর বিশ্বকাপই শেষ হয়ে গেছে, সেটি তখনো চূড়ান্ত নয়। তবে এই ম্যাচে ব্যাটিং করতে পারবেন না, তা জানা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ওভারে সৌম্য উইকেটকিপারের গ্লাভসে ধরা পড়ার পর স্কোরবোর্ড ৫/১ দেখালেও সেটি আসলে ৫/২। ৩১৮ তখন মাঠের পেছনে পাহাড়ের উচ্চতা ছাড়িয়ে যেন এভারেস্টে পরিণত!
তা বাংলাদেশকে সেই এভারেস্টে তুলে দেওয়ার কাজটা কে করলেন? এই জয়ের আসল মহিমা সেখানেই। বিরতির সময় ডিন জোন্স বাংলাদেশের জয়ের একটাই ‘রেসিপি’ দেখছিলেন। কারও ব্যাট থেকে কোয়েটজারের মতো বড় একটা সেঞ্চুরি চাই। অথচ বাংলাদেশের ইনিংসে কোনো সেঞ্চুরিই নেই! ৯৫ রান করে তামিম ইকবাল অগ্রগণ্য ভূমিকায়। কিন্তু তাঁর পাশেই জ্বলজ্বলে আরও কটি নাম—মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, সাব্বির রহমান। যাঁদের কোনো একজনের অবদান ছাড়াও এই আপাত-অসম্ভব সম্ভব হতো না। ‘সবে মিলে করি কাজ’-এর আদর্শ এক উদাহরণ বাংলাদেশের রান তাড়া করার স্মরণীয় এই উপাখ্যান।
যেটি শেষ হওয়ার পর ডেভিড লয়েডকে আর খুঁজে পেলাম না। ইংল্যান্ডের সাবেক ব্যাটসম্যান ও কোচ স্কটল্যান্ড ইনিংসের সময় ধারাভাষ্য দেওয়ার ফাঁকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলে গেছেন, এই মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আয়ারল্যান্ডের জয় তাঁর দেখা সেরা ‘চেজ’। লয়েডকে খুঁজছিলাম একটা সংশোধনী দিতে পারেন ভেবে। বাংলাদেশের প্রথম উইকেটটি পড়ার পরের কিছুক্ষণই শুধু ম্যাচটিকে ঘিরে অনিশ্চয়তার বাতাবরণ। তামিম আর মাহমুদউল্লাহর দ্বিতীয় উইকেট জুটি সেটিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে শুরু করার পর আর কখনোই মনে হয়নি, এই ম্যাচে বাংলাদেশ হারতে পারে।
স্কটল্যান্ডের ইনিংসে যেমন রেকর্ডের ছড়াছড়ি, বাংলাদেশের ইনিংসেও তা-ই। তামিম ইকবাল বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হতে হতে ৫ রানের জন্য পারলেন না। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ডটি অবশ্য ঠিকই হলো। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে তাঁর ভয়-তাড়ানিয়া ১৩৯ রানের জুটিটিও যেকোনো উইকেটে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ রেকর্ড। ওয়ার্ডলের বলে মাহমুদউল্লাহ অদ্ভুতভাবে বোল্ড হওয়ার পর মুশফিক এসে ৪২ বলে ৬০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেললেন। মুশফিক যখন ফিরে যাচ্ছেন, সমীকরণটা ৭২ বলে ৭২ রান। সাকিব আর সাব্বির যেটিকে রীতিমতো ছেলেখেলা বানিয়ে ছাড়লেন।
এই ম্যাচের আগে আইসিসি বিশ্বকাপের একটা পরিসংখ্যান দিয়েছে। যেটি বলছে, সাকিবের খেলা শটের ৭২ শতাংশই আক্রমণাত্মক। এই বিশ্বকাপে এত ব্যাটিং তাণ্ডব, তবে কমপক্ষে ১০০ বল খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আক্রমণাত্মক শট খেলার দিক থেকে সাকিবই সবার ওপরে। ৫টি চার ও ১টি ছয়ে কালকের ৪১ বলে ৫২ রানের ইনিংসটির পরও তাঁর সেখানেই থাকার কথা। ব্যাটিংয়ের মতো বোলিংয়েও সমান উজ্জ্বল। সাকিবের মাধ্যমে এই বিশ্বকাপ প্রথমবারের মতো কোনো স্পিনারকে নতুন বলে বোলিং করতে দেখল। শুরুতে ছিলেন, মাঝে থাকলেন, এলেন আবার শেষেও। রানবন্যার এই ম্যাচেও ওভারপ্রতি মাত্র ৪.৬০ রান দিয়ে ১ উইকেট।
উইকেট একটি পেয়েছেন সাব্বিরও। ম্যাচের সবচেয়ে বড় ছক্কাটিও তাঁর ব্যাট থেকেই। নেলসনের এই মাঠে মিস হিটও ছক্কা হয়ে যায়। তবে সাব্বিরের সেই ছক্কাটি মেলবোর্নেও বড় ছক্কাই হতো। সেটি যে ৯৭ মিটার উড়ে গিয়ে মাঠের বাইরে পড়েছে। হয়তো ইংল্যান্ড শিবিরেও!
বিশ্বকাপের শ্বাসরোধী চাপের কথা বলেছিলাম। কিসের চাপ, এই ম্যাচে জয়-পরাজয়ে না কিচ্ছু আসে যায় না! হারলেও কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে পরের দুটি ম্যাচের একটি জিততে হতো। জেতার পরও সমীকরণটা একটুও বদলায়নি। তার পরও চাপ ছিল। একটা সহযোগী দেশের বিপক্ষে হেরে বসলে কি আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাডিলেড ওভালে নামার জন্য মাশরাফিদের এমন টগবগ করে ফুটতে দেখা যেত!
Category: 1stpage, Scroll_Head_Line, খেলাধুলা, শীর্ষ সংবাদ