গরু ব্যাপারীদের মাথায় হাত
দেশের খবর: ‘গরু আর ঢাকাত পাঠান না বাহে। ওইঠাকার বাজার খারাপ। যেগুলা আছে, ওইলা ওমপুরত বেচি দাও। বেশি লস হবারনায়।’_ শনিবার সকালে রাজধানীর মেরাদিয়া হাট থেকে মোবাইল ফোনে এভাবেই ব্যবসায়িক অংশীদারকে সতর্ক করছিলেন রংপুরের গরু ব্যাপারী মোতাহার আলী।
তিনি জানান, তিন ট্রাক গরু নিয়ে দুই দিন আগে ঢাকায় এলেও শুধু শুক্রবারই একটি বিক্রি হয়েছে। তাও আবার কেনা দামের চেয়ে দেড় হাজার টাকা কমে। অথচ নির্বাচনী বছরে ঢাকায় ভালো বেচাকেনা হবে_ এই আশায় সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রায় ১০০ গরু কিনে মজুদ করেছেন। পাশাপাশি আরো কিছু গরু আনতে টাকা আগাম দিয়েছেন ভারতীয় পাচারকারীদের।
হতাশ মোতাহারের ভাষ্য, দুই দিন ধরে যেভাবে দর পড়ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে তার মতো হাজার হাজার গরু ব্যাপারীর ঘরবাড়ি বেচে মোটা সুদে নেয়া ধার-দেনা পরিশোধ করতে হবে। তবে শেষ সময়ে দাম বাড়বে_ এই আশায় এখনো অনেকেই বুধ বেঁধে আছে।
তবে সরেজমিন রাজধানীর সব ক’টি পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, ঈদের ৪ দিন বাকি থাকলেও ইতোমধ্যে প্রচুর গরু ঢাকায় এসেছে। এরপরও প্রতিদিনই ট্রাক ও ট্রলার ভরে বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার গরু আসছে। বিশেষ করে ভারতীয় গরুতে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। সেই তুলনায় হাটে ক্রেতার সংখ্যা কম। হাট ইজারাদারদের ধারণা, ঈদ ঘনিয়ে এলে ক্রেতার সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও এবার চাহিদার তুলনায় গরুর জোগান দেড়-দুই গুণ হবে। তাই ব্যাপারীদের সঙ্গে তাদেরও বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা যাবে।
গরুর ব্যাপারীরা জানান, এবারকার কোরবানির ঈদের আগে ভারতীয় গরুর পাচার বন্ধ করে দেয়া হবে_ এমন গুজবে অধিকাংশ ব্যাপারীই মাসখানেক আগে থেকে বৈধ ও অবৈধ পথে আনা গরুর মজুদ শুরু করেন। কেউ কেউ বায়না করেন গৃহস্থ এবং ফার্মমালিকদের গরুরও। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাস না পেরোতেই শুরু হয় ভেল্কিবাজির খেলা। বানের পানির মতো চোরা ও বৈধ পথে আসতে শুরু করে গরু-মহিষ। ফলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই গোটা বাজার চলে যায় ভারতীয় পশুর দখলে।
এদিকে, নির্বাচনী বছরে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় রাজধানীতে কোরবানির পশুর চাহিদা কমেছে। অথচ ব্যাপারীদের মূল টার্গেট থাকে সেখানেই। তাই গ্রামের চেয়ে ঢাকায়ই গরুর দাম কমেছে বেশি।
কুষ্টিয়ার গরু ব্যাপারী সাইফুদ্দিন শনিবার সকালে কমলাপুর হাটে এই প্রতিবেদককে জানান, তার যে গরু গ্রামের বাড়িতে ৬০ হাজার টাকা দাম উঠেছে, ঢাকায় ক্রেতারা সেই গরুর দাম ৪০ হাজার টাকা হাঁকছে।
একই কথা জানিয়েছেন শার্শার গরু ব্যাপারী জয়নাল শেখও। তিনি বলেন, ‘২০ হাজার টাকা ট্রাকভাড়া দিয়ে ঢাকায় গরু এনেই ধরা খেয়েছি। এলাকায় বেচলে অন্তত ট্রাকভাড়াটা বাঁচত।’
দয়াগঞ্জ থেকে আসা সুমন ব্যাপারী বলেন, ‘সরকার ভারতীয় সীমান্ত এমন আওলাই দিছে (খুলে দিয়েছে) যে, আমাদের দেশি গরু ব্যাচোনের (বিক্রি) সময় পাইনি। নয়াবাজারের অধিকাংশ গরু ভারতের।’
সুমন আফসোস করে বলেন, ‘৫০ টাকা কেজি ভুসি কিনে গরু লালন-পালন করছি। হাটে ৫০ হাজার টাকার গরুর দাম হাঁকাচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। লোন করে গরুর ফার্ম দিয়েছি। এবার আমাগোর মতো গিরোস্তের মরণ ছাড়া কোনো পথ নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘মানুষের কাছে টাকা নেই। হলমার্ক-ডেসটিনি-শেয়ারবাজার মানুষের টাকা নিয়ে গেছে, গরু কিনব কী দিয়া।’ গরু বিক্রি না করে বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলে জানান সুমন।
শুধু নয়াবাজার নয়, শুক্রবার মধ্যরাতে অস্থায়ী পশুর হাট কমলাপুরে গিয়েও দেখা গেছে একই অবস্থা। রাতে পশু ট্রাকে লোড দিচ্ছেন ব্যাপারীরা।
কমলাপুরে রাত ১টায় জামালপুর থেকে আসা আবুল ব্যাপারী জানান, তার ২০ বছরের ব্যবসাজীবনে হাটের এমন খারাপ অবস্থা দেখেননি।
এদিকে, শেষ সময়ে গরুর দাম বাড়বে_ এই আশায় বড় পাইকারদের কেউ কেউ বেচা-বিক্রি বন্ধ রাখলেও ছোট ব্যাপারীরা কোনো রকমে মূলধন তুলে নিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
আগারগাঁও হাটে ঝিনাইদহের গরু ব্যাপারী মোখলেস জানান, বুধবার ৩০টি গরু নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু শুক্রবার পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি। তাই আর ঝুঁকি নিতে চাইছেন না তিনি। লাভ না হোক, অন্তত কেনা দামে গরু বিক্রি করে লোকসানের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন। তবে অনেকে তাতেও ব্যর্থ হচ্ছেন।
কমলাপুর পশুর হাটে আবু বকর নামের একজন ব্যাপারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিবেদককে জানান, যে গরু শুক্রবার ক্রেতারা ৫৫ হাজার টাকা বলে গেছে, সেই গরুই শনিবার ৫০ হাজার টাকা বলছে। অথচ ওই গরু তিনি ৬০ হাজার টাকায় কিনেছেন। এর সঙ্গে গাড়িভাড়াসহ অন্যান্য খরচ রয়েছে।
আবু বকর জানান, গরুপ্রতি দু-চার হাজার টাকা ক্ষতি হলেও দ্রুত মূলধন তুলতে চাইছেন তিনি। কারণ, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তিনি গরু কিনেছেন। কোনো কারণে ঈদের আগে গরু বিক্রি করতে না পারলে ঋণের টাকা পরিশোধ করা তার জন্য কঠিন হবে। এতে সুদের টাকা শোধ করতে গিয়ে তার ছোট চালানও গচ্চা যাবে।
আফতাবনগর পশুর হাটে গিয়ে দেখা গেছে, পাইকার ও ব্যাপারীরা গরু নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা জানান, হাটে ক্রেতা নেই। সামান্য যে ক’জন আছে, তারা রাস্তার পাশ থেকে গরু কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তাই সবাই সেখানেই ভিড় করছে।
এদিকে, বড় অঙ্কের ক্ষতির আশঙ্কায় বড় পাইকারদের অনেকেই বিকল্প পথও খুঁজছেন।
পাবনার ব্যাপারী ইস্কান্দার জানান, গরুর দাম বেশি কমে গেলে তিনি তা এলাকায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। সেখানে এক-দেড় মাস রেখে পরে বিক্রি করবেন। কয়েকদিন পরেই ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে গরু আসা বন্ধ হয়ে গেলে দেশে গরুর দাম বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
এদিকে, গরুর দর পতনে বিক্রেতাদের মাথায় বাজ ভেঙে পড়লেও খুশি ক্রেতারা। দাম কমে পাওয়ায় অনেকেই মাঝারি সাইজের গরু ছেড়ে ৫-১০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে বড় গরু কিনছেন। ছাগল কিনতে এসে কেউ কেউ ভাগে গরু কিনে নিয়ে গেছেন।
মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসিন্দা আব্দুল হামিদ জানান, তিনি এ বছর খাসি কোরবানি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গরুর দাম অনেক কমেছে শুনে আগারগাঁও হাটে গিয়ে ২২ হাজার টাকায় ছোট সাইজের গরু কিনে এনেছেন। দুই ভাইয়ে মিলে তা কোরবানি দেবেন।
এদিকে, গরুর দাম এখন কম থাকলেও সোমবারের পর দাম হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে_ এই আশঙ্কায় শনিবার কেনার কাজ সেরে ফেলেছে অনেকেই। তাদের ভাষ্য, ‘কোরবানির পশুর ব্যাপারে বেশি ঝুঁকি নিতে চাই না। পাছে আবার বিপদ জেঁকে বসে।’ তবে অনেকেই আবার শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার পক্ষে। তাদের আশা, যেভাবে ভারতীয় গরু দেশে ঢুকেছে, তাতে দিন যত যাবে, গরুর দাম ততই কমবে।
রামপুরার বাসিন্দা তৌহিদুর রহমান জানান, গত বছর যে গরু ৭০-৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, এ বছর ওই একই সাইজের গরুর দাম বিক্রেতারাই ৬০-৬৫ হাজার টাকা হাঁকছেন। দর কষাকষি করলে সহজেই আরো ৪-৫ হাজার টাকা কমাচ্ছেন। তবে এরপরও অনেকেই গরু না কিনে আরো দর পতনের অপেক্ষা করছেন।
তৌহিদ আরো জানান, তিনি নিজেও সোমবারের পর গরু কিনবেন। তার আশা, এবার শেষ সময়ে দর আরো পড়বে।
এদিকে, গরুর বাজারে বড় ধরনের দর পতনে রাজধানীর হাট ইজারাদাররাও চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। মেরাদিয়া, আরমানিটোলা, সাদেক হোসেন খোকা মাঠ এবং আগারগাঁওসহ বেশ কয়েকটি হাটের ইজারাদারদের আশঙ্কা, এবার তাদের মোটা অঙ্কের টাকা গচ্চা যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি হাটের ইজারাদার জানান, এক কোটি টাকার হাটের ইজারা নিতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন এবং রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন লেভেলের লোকজন ম্যানেজ করতে আরো ৫০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। অথচ গরুর দাম যেভাবে কমছে, তাতে আসল টাকা তোলাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
রাজধানীর বাজারে গরুর দাম পড়ে যাওয়ার জন্য মিডিয়াকে দোষারোপ করছেন গরু ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও ইজারাদাররা। ভারতীয় গরুর ব্যাপক আমদানি এবং গরু মোটাতাজাকরণে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মিডিয়ায় প্রতিবেদন হওয়ার পর গরুর দাম পড়ে যায় বলেও অভিযোগ করেন তারা।