বিতর্কের মুখে দুদক: গ্রেফতার অভিযান চলছে, নজরদারিতে হাসান ও হোসেন।
দেশের খবর: কমিশনের দায়ের করা মামলায় সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ চার আসামিকে গ্রেফতার করতে অভিযানে নেমেছে দুদকের বিশেষ টিম। যে কোনো সময় আসামিরা গ্রেফতার হতে পারেন বলে জানিয়েছেন দুদকের স্কোয়াড্রন লিডার মো: তাহিদুল ইসলাম। জানা গেছে, আসামিদের গ্রেফতার করতে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে।
দুদক জানিয়েছে গ্রেফতার অভিযানের পাশাপাশি দুই সন্দেহভাজন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে বিশেষ নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এদিকে পলাতক আসামিদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দুদক।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ নাটকীয়তার পর ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে সাত জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই মামলায় সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন বা সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে আসামি করা হয়নি।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে পরপর দু’বার সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে দায়মুক্তি দেওয়ায় বিতর্কের মুখে পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।পদ্মাসেতুর দুর্নীতির মামলায় এজাহারের বর্ণনায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর নাম থাকলেও আসামির তালিকায় `কৌশলে` বাদ দিয়েছে দুদক।
দুদকের উপ পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ সোমবার রাজধানীর বনানী থানায় এ মামলা দায়ের করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয়েছে সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে।
এছাড়াও এ মামলায় আসামি হলেন যারা-
মামলার আসামিরা হচ্ছেন- সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট লিমিটেডের (ইপিসি) উপ-পরিচালক মো. মোস্তফা, এসএনসি লাভালিনের সাবেক পরিচালক (আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের) মোহাম্মদ ইসমাইল, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও কেভিন ওয়ালেস।
এ সাতজনের বিরুদ্ধে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে, ‘‘আসামিগণ ১৯৬১ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অপরাধ করার অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করেন। যা দণ্ডবিধির ১২০ (বি) ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’’
এসএনসি লাভালিন ওই কার্যাদেশ পেলে ‘ঘুষ লেনদেন সম্পন্ন হতো’ বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী প্রসঙ্গে
এজাহারে বলা হয়েছে, ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রে তাদের ভূমিকার বিষয়ে অনুসন্ধানে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি দুদক। মামলার তদন্তের সময় তাদের বিষয়ে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। তবে দুদকের দাবি, আবুল হোসেন ও আবুল হাসানকে ‘দায়মুক্তি’ দেওয়া হয়নি। আসামি না করা হলেও এজাহারে সন্দেহভাজন হিসেবে তাদের নাম রয়েছে।
মামলার বাদী ও দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ-আল জাহিদ ব্রিফিংয়ে বলেন, “দুঃখের বিষয়, আমরা বাংলাদেশে যা পেয়েছি (জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যানুযায়ী) তা দিয়ে মামলা করেছি। কানাডা থেকে এখনও আমরা রমেশের নোটবুকের অনুলিপি, প্রতিলিপি, ফটোকপি কিংবা কোনো ডকুমেন্ট পাইনি। তবে খুব শিগগিরই পাবো বলে আশা করছি। পাওয়ার পরই এই দু`জনের (আবুল হাসান ও আবুল হোসেন) বিরুদ্ধে দালিলিক তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৯১ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্থগিত করে বিশ্ব ব্যাংক।
দুদক এরপর তদন্ত শুরু করলেও সরকার এবং তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন দুর্নীতির অভিযোগ নাকচ করে অনড় থাকেন। এই প্রেক্ষাপটে গত জুন মাসে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক।
এরপর আবুল হোসেনের পদত্যাগ, প্রকল্পের ইন্টেগ্রিটি অ্যাডভাইজর ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান এবং সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে ছুটিতে পাঠানোসহ সরকারের নানামুখী তৎপরতায় বিশ্ব ব্যাংক সিদ্ধান্ত বদলায়।
তাদের দেয়া শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রসিকিউটর লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্যানেল দুদকের তদন্ত পর্যবেক্ষণে দুই দফা ঢাকা সফর করে। এই প্যানেলের প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করছে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মাণ, যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।
দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধান পর্যায়ে সৈয়দ আবুল হোসেন, আবুল হাসান, মোশাররফ হোসেনসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতি দমন কমিশন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন প্রকল্পের ইন্টেগ্রিটি অ্যাডভাইজর ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান, সাবেক প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম, জাতীয় সংসদের হুইপ নূর আলম চৌধুরী লিটনের ভাই নিক্সন চৌধুরী ও এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় এজেন্ট জিয়াউল হক।
এছাড়া প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মূল্যায়ন কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. আনম সফিউল্লাহ, পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশতিয়াক আহমেদ, সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী তরুণ তপন দেওয়ান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মকবুল হোসেন, ইস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক মো. দলিল উদ্দিন ও সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মো. ফেরদৌসও জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন।
তদন্ত শুরুর পর দুদক দীর্ঘদিন দুর্নীতির কোনো তথ্য প্রমাণ না পাওয়ার কথা বললেও তদন্তকারী এ সংস্থার চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গত ২৭ নভেম্বর সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা প্রকল্পের কাজ পেতে ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রে’ প্রমাণ পেয়েছেন অনুসন্ধানকারী প্যানেল।
দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ-আল জাহিদ, মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী, গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী ও উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল আলমকে নিয়ে গঠিত ওই ‘অনুসন্ধান প্যানেল’ গত ৪ ডিসেম্বর কমিশনে যে প্রতিবেদন জমা দেয়, তাতে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করা হয়।
ঠিক কতোজনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ এসেছে- সে সময় তা না জানালেও গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ওই সংখ্যা ১০ এর কম।
অনুসন্ধান প্যানেলের ওই প্রতিবেদন নিয়ে গত ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব ব্যাংকের তিন পর্যবেক্ষকের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন দুদক কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকের পর দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, দুর্নীতির ‘ষড়যন্ত্র’ যে হয়েছিল, সে বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক ও দুদক ‘একমত’ হলেও কার কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে- সে বিষয়ে মতৈক্য হয়নি।
শেষ পর্যন্ত মতৈক্য ছাড়াই ঢাকা ছাড়েন বিশ্ব ব্যাংকের পর্যবেক্ষক ওকাম্পো ও তার সঙ্গী টিমোথি টং ও রিচার্ড অল্ডারম্যান।
এরপর ৮ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বিশ্ব ব্যাংক সাফ জানিয়ে দেয়, দুর্নীতি দমন কমিশন ‘সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ’ তদন্ত না করা পর্যন্ত তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না ।
Category: 1stpage, Scroll_Head_Line, দেশের খবর, প্রচ্ছদ