রানা প্লাজায় নিহত, নিখোঁজ এবং আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ
দেশের খবর: রানা প্লাজায় নিহত, নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজন এবং আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে সরকারি উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি।
কমিটির সুপারিশ হচ্ছে, প্রত্যেক নিহত, নিখোঁজ (যাচাই সাপেক্ষে) শ্রমিকের পরিবার এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিক ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর আহত হওয়ার ধরন অনুযায়ী শ্রমিকেরা পাবেন দেড় লাখ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত লাখ টাকা। এই অর্থ কে কে দেবে, তা ঠিক করে দেবেন আদালত।
তবে মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই পরিমাণ টাকা দিতে বেঁকে বসেছে। এটা না দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় দেনদরবারও করছেন বিজিএমইএর নেতারা। তাঁরা শ্রম আইন অথবা তাজরীনের শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদাহরণ টেনে টাকার অঙ্ক কমানোর চেষ্টা করছেন।
গত ২৪ এপ্রিল সাভারে আটতলা রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৪ জন নিহত ও দুই সহস্রাধিক শ্রমিক আহত হন। ওই ভবনে পাঁচটি পোশাক কারখানা, বিপণিবিতান ও ব্যাংক ছিল। শনাক্ত না হওয়া ২৯১টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনো কঙ্কাল ও মানুষের হাড় উদ্ধার হচ্ছে।
ভবনধসের এ ঘটনাটি ছিল বিশ্বে ২০১৩ সালের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার একটি। বিশ্বের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে এখনো বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। সবার নজর থাকার পরও এখনো অনেক নিহত শ্রমিকের পরিজন ও আহত ব্যক্তিরা সহায়তা পাননি। আদালতের নির্দেশে সরকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও মালিকপক্ষ আপত্তি জানাচ্ছে। যদিও রানা প্লাজা ধসের পর অনেক শঙ্কা থাকলেও পোশাক রপ্তানিতে এখনো বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
গত ২৯ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের বেঞ্চের স্বতঃপ্রণোদিত রুলের পরিপ্রেক্ষিতে সাভার সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীকে প্রধান করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠিত হয়। কমিটির নাম হয় ‘রানা প্লাজার ভবনধসের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিবর্গের ক্ষতিপূরণের হার নির্ধারণের নিমিত্তে মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশিত কমিটি’। গত ২৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত কমিটির প্রথম সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশকে প্রধান করে ‘ক্ষতিপূরণের হার ও ক্ষতিগ্রস্তের প্রকার নির্ধারণ সাবকমিটি’ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) এ বি এম আবদুল হান্নানকে প্রধান করে ‘অসামর্থ্যতার প্রকৃতি নির্ধারণ সাবকমিটি’ গঠন করা হয়।
একাধিক বৈঠক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পর সর্বশেষ ১৬ জানুয়ারি কমিটির সভায় ক্ষতিপূরণের হার নির্ধারণ করে সুপারিশ চূড়ান্ত করা হয়। কমিটি এখন এই সুপারিশ হাইকোর্টে জমা দেবে।
ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ উপকমিটির প্রধান এম এম আকাশ প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে কমিটি নিহত শ্রমিকদের জন্য ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে দুঃখ-যন্ত্রণা বাবদ (কস্ট ফর পেইন অ্যান্ড সাফারিংস) পাঁচ লাখ টাকা ধরা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিধানে দুঃখ-যন্ত্রণা বাবদ ক্ষতিপূরণের কোনো উল্লেখ না থাকায় পরে তা বাদ দেওয়া হয়। আরেকটি উপকমিটির প্রধান এ বি এম আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে জানান, আহত ব্যক্তিদের প্রকৃতি নির্ণয়ের কাজ চূড়ান্ত করা হয়েছে।
চার ধরনের আহত: কমিটির সুপারিশে আহত শ্রমিকদের আঘাতের ধরন ও ক্ষতির প্রকৃতি অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে স্থায়ীভাবে পঙ্গু শ্রমিকদের জন্য ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করা হয়েছে। স্নায়ুরজ্জুতে (স্পাইনাল কর্ড) আঘাত পাওয়া, দুই বা ততোধিক অঙ্গহানি হওয়া শ্রমিকেরাও এই ভাগে পড়বেন এবং একই হারে ক্ষতিপূরণ পাবেন। দ্বিতীয় ভাগে এক হাত বা এক পা হারানো শ্রমিকদের সাড়ে সাত লাখ টাকা এবং তৃতীয় ভাগে দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা প্রয়োজন—এমন শ্রমিকদের সাড়ে চার লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করা হয়েছে। চতুর্থ ভাগে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের দেড় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
রানা প্লাজার সব আহত ও অসুস্থ ব্যক্তিদের পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বিনা খরচে সার্বিক চিকিৎসা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যাঁদের অঙ্গহানি হয়েছে, তাঁদের একটি স্থায়ী কার্ড দেওয়া হবে; যাতে তাঁরা আজীবন তাঁদের কৃত্রিম অঙ্গের রক্ষণাবেক্ষণ সরকারি হাসপাতালে বিনা পয়সায় করাতে পারেন। আর ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত উত্তরাধিকার আইন অনুসারে দাবিদারেরা ভাগ পাবেন।
কমিটি রানা প্লাজা ভবনে অবস্থিত নিউ ওয়েভ স্টাইল, নিউ ওয়েভ বটম, ফ্যান্টম অ্যাপারেলস, ফ্যান্টমটেক ও ইথারটেক্সের চাকরিহারা কর্মক্ষম শ্রমিকদের সমপর্যায়ের চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এটা বিজিএমইএ করবে। সুপারিশে বলা হয়েছে, ক্ষতিপূরণের এই হার শুধু রানা প্লাজার জন্য। অন্য কোনো শিল্প বা একই শিল্পের অন্য দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এ হার প্রযোজ্য হবে না।
ক্ষতিগ্রস্ত উদ্ধারকর্মীদের সঠিক তালিকা না থাকায় তাঁদের বিষয়ে সুপারিশ যৌক্তিক হবে না বলে কমিটি মনে করেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উদ্ধারকর্মীদের তালিকা করলে তাঁদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে যেসব উদ্ধারকর্মী পঙ্গু বা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণ হবে কমপক্ষে মৃত শ্রমিকদের অনুরূপ।
আদালতে ফয়সালা: ক্ষতিপূরণের অর্থ কে দেবে—এ প্রসঙ্গে এম এম আকাশ বলেন, ‘ভবন মালিক, কারখানা মালিক, বিজিএমইএ, বিদেশি ক্রেতা ও সর্বোপরি সরকারি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণের অর্থ সংগৃহীত হবে। আমরা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করছি না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত।’
অধ্যাপক আকাশ বলেন, ক্ষতিপূরণ, ত্রাণ আর চাকরিচ্যুতির ফলে প্রাপ্ত সুবিধা তিনটিই পৃথক বিষয়। একটির সঙ্গে আরেকটি মেলানো যাবে না। ইতিমধ্যে যেসব ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা স্বজন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে যে সাহায্য পেয়েছেন, তা কোনোভাবেই এই ক্ষতিপূরণের সঙ্গে সমন্বয় করা যাবে না। তবে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে যে টাকা তাঁরা পেয়েছেন, তা এই ক্ষতিপূরণের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে আসা কোনো তহবিল সরকার অনুমোদন করলে কেবল সেটিকেই ক্ষতিপূরণের সঙ্গে সমন্বয় করা যাবে।
মালিকপক্ষের অমত: কমিটির সদস্য ও বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি স্বাক্ষর করেছি। তবে আমি লিখিত দিয়েছি, ক্ষতিপূরণ শ্রম আইন অনুযায়ী হতে হবে।’ জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নির্ধারণ করলেই হবে না। এই টাকা কোথা থেকে আসবে, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশি ক্রেতারা যদি ক্ষতিপূরণের বৃহৎ অংশ দেন, তবে আমাদের আপত্তি নেই। তবে মালিক বা বিজিএমইএর ঘাড়ে এককভাবে এটি চাপিয়ে দিলে সম্ভব না।’
শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, যদি কোনো শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন, তবে তিনি ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ ও কোনো শ্রমিক সম্পূর্ণ অক্ষম হলে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা পাবেন। যদিও তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের পর নিহত ব্যক্তিদের সাত লাখ ও আহত ব্যক্তিদের এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়। তবে মালিক বা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় শ্রমিকেরা নিহত হওয়ায় ক্ষতিপূরণের অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়া প্রয়োজন বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, ‘আমরা নিহত ও আহত শ্রমিকদের হারানো আয়ের (লস অব আর্নিং) হিসেবে ক্ষতিপূরণ চাইছি। যেটা কখনোই ২২ লাখের কম হবে না। আমরা বলছি, কারখানার মালিক, বিদেশি ক্রেতা, সরকার ও বিজিএমইএকে যৌথভাবে এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’
Category: 1stpage, Scroll_Head_Line, দেশের খবর, শীর্ষ সংবাদ