• ১ জ্যৈষ্ঠ ,১৪৩১,16 May ,2024
  • ব্রেকিং নিউজ : বাংলাদেশের রিকশাচিত্র পেল ইউনেস্কোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি

বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি বাদশা ভাই-চলে গেলেন না ফেরার দেশে

| ফেব্রুয়ারী 14, 2015 | 0 Comments

Aminul_Haque_badshahইউরোবিডি কমিউনিটি সংবাদ:

হেফাজুল করিম রকিব : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্ব পালনকারী ও লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক এবং লেখক আমিনুল হক বাদশা লন্ডনের কেন্টের অরপিংটনের ফানবারা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লড়তে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন । অথচ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার প্রতি কি দায়িত্ব পালন করছে? নেই হাই কমিশনের দায়িত্ব, নেই তার আপন মানুষগুলোা দায়িত্ব! দু:খ ভারাক্রান্ত মনে ভাবতেই গা শিউরে ওঠছে- তাহলে সময়ের বিবর্তনে বাদশা ভাইও হারিয়ে গেল ।

যে মানুষটি স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। যিনি সাংবাদিক হিসেবেও রেখেছেন অনন্য অবদান। যিনি জীবনভর শুনিয়েছেন দেশপ্রেম আর সাধারণ মানুষের গল্প। তিনি আজ কথা বলতে পারছেন না? হাসপাতালের বেডেই চির নিন্দ্রায় ‍শুয়ে থাকছেন । তিনিঘুমিয়ে পড়ছেন, আর কখনো উঠবেননা ।

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আমিনুল হক বাদশা গত মাস খানেক ধরে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর আগে তাঁর বাইপাস অপারেশন হয়েছে। হৃদপিণ্ডের বাল্ব সংযুক্ত করার পর আবারও তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্ব পালনকারী এই সৌভাগ্যবান সাংবাদিক কি এমন জীবন চেয়েছিলেন? বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে এসেও আমিনুল হক বাদশাকে দেখতে না যাওয়ার ঘটনায় চলছে নানা সমলোচনা। তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী জানেন না, তাঁর কথা? কিন্তু সেটা কেমন করে সম্ভব? আর জানলে, তিনি তাঁকে একটিবারের জন্যও দেখতে এলেন না কেনো? -এ নিয়ে এখন লন্ডনের সাধারণ বাঙালির মনে ঘুরপাক খাচ্ছে নানান প্রশ্ন।

হ্যাঁ, সেই বাদশা ভাইকে আমি চিনি ২০১০ থেকে। তখন ইউকে-এটিএন বাংলায় কাজ করি। হঠাৎ দুপুরে একদিন অফিসে আসেন বাদশা ভাই। তিনি অফিসে ঢোকার পর জমজামট আড্ডা শুরু হলো। আমিও সেই আড্ডায় মজে গেলাম। তখনও আমি জানতাম না- উনি কোন পর্যায়ের মানুষ। আড্ডার শেষ পর্যায়ে হঠাৎ জিঞ্জেস করলো- তুমি কি করো? তখন আমার সহকর্মী কাদের ভাই পরিচয় করে দিল আমাকে। পরে কাদের ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম ঊনার গর্বিত জীবনের নানা দিক। এরপর থেকে মাঝে মাঝে বিভিন্ন কমিউনিটির প্রোগ্রামে দেখা হতো বাদশা ভাইয়ের সাথে। ধীরে ধীরে জানতে পারলাম- বাংলাদেশের রাজনীতির একসময়কার তুখোড় মেধাবী এই ব্যক্তিত্ব এখন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের কাছে অবমূল্যায়িত। আহ, বাদশা ভাই, জীবনে তো খালি দিয়েই গেলেন, কিন্তু আপনার প্রতি এ কেমন উপেক্ষা বাঙালি রাজনীতিবিদদের?

কতো মজার একজন মানুষ আপনি- অথচ আজ আপনি হাসপাতালের বেডে? এ যে আপনাকে মানায় না? আপনার যে আরও অনেক কাজ বাকী রয়ে গেছে- নতুন প্রজম্মকে উৎসাহিত করা, প্রবাসীদের দেশীয় শেকড়ে একীভূত করে রাখতে যে আপনার সদাহাস্য সহযোগিতার আমাদের বড়োই অভাব।

সত্যি বলতে কি- লন্ডনপ্রবাসী বাঙালি কমিউনিটিতে বাদশা ভাইয়ের বিচরণ ছিল চোখে পড়ার মতো। যদিও তাঁর প্রকৃত নাম- খোন্দকার আমিনুল হক। কিন্তু তিনি বাদশা নামেই সব জায়গায় পরিচিত। বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি ও কমনওয়েলথ সাংবাদিক এসোসিয়েশন ইউরোপের নির্বাহী সদস্য তিনি।

একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবার থেকে আসা এই মহান মানুষটির পিতা খন্দকার লুতফুল এবং মা সকিনা বেগম। ১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবর কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ঊনার পিতা একজন আইনজীবী এবং বড় ভাই একজন সাংবাদিক, অভিনেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর অন্যান্য ভাইও সুনামের সাথে বিভিন্ন পেশায় জড়িত রয়েছেন।

বাদশা ভাই ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সমাজবিজ্ঞানে এম এ সম্পন্ন করেন। অত:পর দীর্ঘপথ পরিক্রমায় ইংল্যান্ডেও সম্পন্ন করেন আরেকটি এম.এ। পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সময় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারাগারে থাকতে হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। বাদশা ভাই মুজিব নগরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বাংলাদেশের স্বাধীনতা রেডিও স্টেশনের প্রতিষ্টাতা এবং মুজিব নগর বাংলাদেশ মিশনের বাহ্যিক প্রচার বিভাগের ডিরেক্টর ছিলেন। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হন। লন্ডনে আসার আগ পর্যন্ত তিনি প্রেস সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে তিনি লন্ডনে চলে আসেন।

তিনি ভারত, বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ড এর বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া এটিএন বাংলা ইউকেতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন। বিবাহিত জীবনে দুটি সন্তান রয়েছে কর্মপ্রিয় এ মানুষটির। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। তিনি সাংবাদিকতায় সততা ও সাহসিকতাকেই পুঁজি করে মানুষের জন্য দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। এবং যেটা বিশ্বাস করেন সেটা জীবন দিয়ে হলেও করতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেন না। তিনি চারটি বই লিখেছেন এবং অনেক বাংলা ছবিতেও অভিনয় করেছেন।

তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের অংশ এই প্রবীণ সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু পরিবারের একজন সদস্যের মতোই ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে যেসব ছাত্রনেতা মঞ্চে ছিলেন তাদেরই একজন এই আমিনুল হক বাদশাহ। যাকে বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি পছন্দ করতেন।

লেখক লুৎফুর রহমান তাঁর এক লেখায় লিখেন- “স্বাধীনতার পর ভারতে বাংলাদেশের যে সমস্ত নোট মুদ্রিত হতো, তার মধ্যে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া গেলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত নতুন নোট বাজারে ছাড়া হবে। এ উদ্দেশ্যে দেশের বিশিষ্ট আলোকচিত্রশিল্পীদের কাছে বঙ্গবন্ধুর অনেক ছবি ছিল। তার থেকে একটি ছবি আমি প্রেস ডিপার্টমেন্টে জমা দিই। পরবর্তী সময়ে ছবি নির্বাচন করা হলে দেখা গেল আমার জমা দেওয়া ছবিই মনোনীত হয়েছে। খুশিতে আমার তখন দিশেহারা হয়ে যাওয়ার অবস্থা।…আমার নিজের হাতের তোলা বঙ্গবন্ধুর ছবি পাঁচ টাকা ও দশ টাকার নোটে মুদ্রিত দেখতে পেলাম। ওই ছবির সম্মানি হিসেবে নোট মুদ্রণকারী বিদেশি সংস্থা হোটেল শেরাটনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমার হাতে একটি দামি ক্যামেরা তুলে দিল। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে তার প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশা সচিবালয়ে ডেকে নিয়ে আমার হাতে নগদ ৩ হাজার টাকা তুলে দিলেন। তিনি বললেন, ‘এ টাকার পুরস্কার বড় কথা নয়, তার চেয়ে বড় পুরস্কার সব জায়গাতে সবার হাতে হাতে আপনার ছবি থাকবে।’ বাস্তবিকই তাই। আমার তোলা ছবি সবচেয়ে মূল্যবান জায়গায় স্থান পেয়েছে। একজন ফটোগ্রাফারের জীবনে এর চেড়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?”

সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী লিখেছেন, পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে এলেন ’৭২ এর ১০ জানুয়ারি । পরদিনই প্রেস সেক্রেটারি, সাংবাদিক ও লেখক আমিনুল হক বাদশা ভাইকে দিয়ে এবিএম মুসাা ভাইকে ডাকানো হয়।

-বঙ্গবন্ধুর এমনই ঘনিষ্ট ছিলেন বাদশা ভাই। এখানে শুধু দুয়েকটা বিষয় তুলে ধরলাম। বাদশা ভাই কী ছিলেন- কেমন মানুষ তা তাঁর সাথে না মিশলে কখনো বোঝা যাবে না। হাজার হাজার লেখাতে বাদশার ভাইয়ের নাম এসেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বাদশা ভাই এক উল্লেখযোগ্য নাম। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে তিনি ওৎপোতভাবে জড়িত।

যে জাতি বাদশা ভাইদের সত্যিকারের মুল্যায়ন করতে পারবে না, তাদেরকে কেউ মুল্যায়ন করবে- সেটা আমার বিশ্বাস হয় না। দোয়া করি- বাদশা ভাই, পৃথিবীর ঐপাড়ে আপনি ভালো থাকবেন । শুধু বলতে চাই- এখনো আপনি আগের মতোই প্রাসঙ্গিক বাদশা ভাই। আপনাকে ছাড়া আড্ডা যে বড়ো খালিখালি লাগবে বাদশা ভাই।

Category: 1stpage, Community UK, Scroll_Head_Line, ইউরোবিডি কমিউনিটি সংবাদ

About the Author ()

Leave a Reply