‘হাওয়া ভবন খাওয়া ভবন’
রুমীন ফারহানা : সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশে কাজ হয়। শেখ হাসিনার কোনও হাওয়া ভবন, খাওয়া ভবন নেই। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে দুর্নীতি হয়েছে তথ্য- প্রমাণসহ খালেদা জিয়াকে তা প্রমাণ করতে হবে। না পারলে তাকে মামলার মুখোমুখি করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের সদ্য সমাপ্ত কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন। সেই সঙ্গে মন্ত্রিত্ব তো আছেই। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে সড়কমন্ত্রী হিসাবে বেশিরভাগ সময় তিনি পথেই কাটাতেন, একে তাকে ধমকাতেন, কান ধরে ওঠবোস করাতেন, বাসে চড়ে দাঁড়িয়ে যেতেন, মিডিয়া সেটা ফলাও করে প্রচার করতো, আমরা মুগ্ধ দর্শক হয়ে তা দেখতাম। তার কথাবার্তা, স্বপ্ন সব রাস্তাকেন্দ্রিকই ছিল। তিনি এখন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক, সুতরাং সব বিষয়ে তার একটা অভিমত থাকবে এবং তা তিনি প্রকাশ করবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার কোনও হাওয়া ভবন নাই, খাওয়া ভবন নাই’। একথার মধ্য দিয়ে তিনি সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি নেই। অথচ আওয়ামী লীগের অত্যন্ত প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন সময় বলেছেন, ‘দুর্নীতি এমন একটি বিষয় যা আমরা টাচই করতে পারিনি’। অর্থমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে আরও বলেছেন, ‘পুকুর চুরি নয় সাগর চুরি হয়েছে’। তথ্যমন্ত্রী কিছুদিন আগে ক্ষমতাসীন দলের কাছে ভীষণভাবে সমালোচিত হন এই বলে যে বেশিরভাগ এমপি টিআর, কাবিখার টাকা মেরে দেন। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বলতে চেয়েছেন যে আওয়ামী লীগে তাকে ছাড়া আর সবাইকে কেনা যায়। পানামা পেপার্সে ভাসছে আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতার গাড়ি ঘাটলেও ৭০ লাখ টাকা পাওয়া যায়। একটি জাতীয় দৈনিকে এসেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ এই পাঁচ বছরে মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদ বেড়েছে ১০৭ গুণ পর্যন্তদ। ২০০৮ সালের নির্বাচনি হলফনামায় যাদের স্ত্রীদের কোনও আয়ই ছিল না, তারাই স্বামীর পাঁচ বছরের ক্ষমতায় এখন শত কোটি টাকার মালিক। কানাডার বেগম পাড়া বা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম ঘুরে আসলেই দেখা যাবে রাজারানি কাব্য।
গত ৩০ জুন ২০১৫ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল ‘ব্যাংকের পরিচালক হও টাকা কামাও’। সেখানে বলা হয়েছিল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা সিংহভাগই সরকারি দলবাজ ও সরকারের ম“পুষ্ট। তারা নিজ ব্যাংক শুধু নয় নামে-বেনামে ঋণ নিচ্ছে অন্য ব্যাংক থেকেও যা পরবর্তী সময়ে খেলাপি ঋণ হয়ে যাচ্ছে। ১৮ মে ২০১৬ আরেকটি দৈনিক পত্রিকায় এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ৭ বছরে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে লোপাট হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহীম খালেদের মতে, গত কয় বছরে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা কখনোই আদায় হবে না। এই বিপুল পরিমাণ টাকা গেছে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবসায়ী আর রাজনীতিকদের ঘরে। অথচ এই টাকা আমাদের টাকা, দেশের ১৬ কোটি মানুষের টাকা। ৩১ মে ২০১৬ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী করের টাকায় টিকে আছে লোকসানি ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের টিকিয়ে রাখতে প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। অবশ্য যে দেশের অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেন ৪ হাজার কোটি টাকা ইজ এ পিনাট; সেদেশে হাওয়া ভবনের মতো শিশুতোষ কাণ্ড হবে কেন, সেখানে সব হবে ডিজিটাল কায়দায় যা ধরতেও বিশেষ প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়বে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ছাড়িয়ে লুট এখন পৌঁছে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। নজিরবিহীন এ ঘটনা ঘটেছে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে আর বাংলাদেশ ব্যাংক তা জেনেছে ওই বছর ৫ ফেব্র“য়ারি যদিও এর অনেক আগেই তাদের জানার কথা। অথচ ২৯ ফেব্র“য়ারি ফিলিপাইনের ইনকোয়ার পত্রিকায় খবরটি প্রকাশের আগ পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেনি দেশের মানুষ। ঘটনা জানার ১ মাস ২ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চুরির ঘটনাটি স্বীকার করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অসৎ উদ্দেশ্য প্রমাণে এই কি যথেষ্ট নয়? ১০ মে’র ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, রিজার্ভ চুরির এই কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত। একই দিনে প্রকাশিত বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক বলছে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সুইফট-এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও জড়িত বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক এর সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন। যদিও ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির দু’টি রিপোর্টের একটিও আলোর মুখ দেখেনি।
গ্লোবাল ফাইনানসিয়াল ইনটিগ্রিটি বলছে গত এক দশকে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে আর ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার সূত্র মতে, গত ১০ বছরে প্রায় ৪৯ হাজার ১৩ কোটি ডলার বা ৩৯ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শুধু ২০১৩ সালেই দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৯ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭০ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা যা দিয়ে ৫/৬ টি পদ্মাসেতু তৈরি করা যায়।
বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন উন্নয়নকে। সেই উন্নয়ন আবার সুশাসন, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন বা মানবাধিকারের উন্নয়ন নয়। এই উন্নয়ন আইয়ুব, মোনায়েম আর এরশাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এই লুটপাট নির্ভর উন্নয়নে প্রতিটি প্রকল্পে দফায় দফায় সময় আর খরচ বাড়ে। ৮ হাজার কোটি টাকার পদ্মাসেতু পিলার ওঠার আগেই গিয়ে ঠেকে ২৮ হাজার কোটি টাকায়, সাড়ে ৩শ কোটি টাকার ফ্লাইওভার হয় ১২০০ কোটি টাকায়, ৬০০ কোটি টাকার হাতিরঝিল ২৫০০ কোটি টাকায়ও শেষ হয় না। অনিয়ম, লুটপাট আর দুর্নীতিতে গত ৪ বছরে ১৩শ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে বিমান। উন্নয়ন অর্থ যদি সড়কমন্ত্রীর সড়ক নির্মাণও হয় তাহলে বলতে হয় সম্ভোবত সোনা দিয়ে রাস্তা বানাই আমরা। কারণ যেখানে এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরিতে ইউরোপে ব্যয় হয় ২৮ কোটি টাকা, চীনে ১৩ কোটি টাকা, ভারতে ১০ কোটি টাকা সেখানে বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয় ১০০ কোটি টাকার ওপর। ৮ জুন ২০১৬ আরেকটি দৈনিক পত্রিকার সূত্রমতে, সড়ক উন্নয়নে গত ৪ বছরে বরাদ্দ ছিল ১৭,৬৫৬ কোটি টাকা। অথচ গত কয়েক বছরে দেশে মোট সড়ক মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ১ কিলোমিটারও বাড়েনি। তাহলে এই টাকা গেল কোথায়? দেশেতো হাওয়া ভবন নেই।
প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখিতা নিয়ে সরকারের আনন্দের সীমা নেই। কিন্তু প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যে বৈষম্য বাড়ছে, সে বিষয়ে সরকারের নীরবতা দৃষ্টিকটু। শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নের চাপে ১৬ কোটি মানুষের দেশে ৪ কোটি এখনও হতদরিদ্র। ব্যাংক একাউন্টের হিসাব মতে ২০০৯ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ১২৯১৭ জন যা ২০১৫ সালে বেড়ে হয়েছে ৪০,৬৮৭ জন। অর্থনীতির নিয়ম বলে আমাদের মতো দেশে ১ জন কোটিপতি তৈরি হলে তার জন্য ১০০০ জন মানুষকে গরিব হতে হয়। এই ৬ বছরে ১২ হাজার থেকে ৪০ হাজারে উন্নীত হওয়া এই কোটিপতিরা আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডা, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়াতে বিনিয়োগ করেছে, অবশ্যই হাওয়া ভবন খাওয়া ভবনে নয়।
আওয়ামী লীগ আর শেয়ারবাজার বড়ই নেতিবাচক উল্টোমুখী সম্পর্ক। একটি ক্ষমতায় উঠলে অন্যটির পতন অনিবার্য। ২০০৯ এ এই দলটি ক্ষমতায় আসলে ৩৩ হাজার বিনিয়োগকারী পথে বসে। ৩ জন আত্মহত্যা করে। শেয়ার বাজার থেকে লুট হয় ১ লক্ষ কোটি টাকা। লুটের আর এক মজার ক্ষেত্র হলো কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। এসব কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনে তার দায় চাপানো হচ্ছে দেশের মৃতপ্রায় অর্থনীতি ও গ্রাহকের ওপর। ৭ দফা দাম বেড়েছে বিদ্যুতের। দলীয় লোকদের কোম্পানিকে কুইকরেন্টাল চুক্তি দেওয়া হয়েছে বিনা টেন্ডারে, দায়মুক্তির সনদে। চুক্তি অনুযায়ী ৩ বছর মেয়াদি কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ ২০১৪ সালে শেষ হওয়ার কথা যদিও লুটের ধারা অব্যাহত রাখতে এর মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়িয়ে চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে।
নব্য হাওয়া ভবন খাওয়া ভবনের এই আলোচনা এক লেখাতে শেষ হওয়ার নয়। জবাবদিহিতা বড় বালাই। এই বালাই যেহেতু নাই, জনগণের ন্যূনতম অংশগ্রহণ ছাড়াই যেহেতু ক্ষমতায় যাওয়া যায় এবং বিরোধী দলের নানামুখী দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে টিকে থাকা যায়, তাই আয়নায় আপাতত আত্মদর্শন না করলেও চলে, বিশেষ করে সে দর্শন যখন খুব সুখকর নয়।
Category: 1stpage, Scroll_Head_Line, দেশের খবর