সুইডেনে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক সেমিনারের নামে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার পাঁয়তারা
শেখ তাসলিমা মুন,স্টকহোম, সুইডেন
গত ১৮ জুন ২০১৩ বিকেল ৫ টায় সুইডিশ পার্লামেন্ট ভবনে বাংলাদেশে সংঘটিত ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় এক ন্যাক্কারজনক সেমিনার আয়োজন করে সুইডেন জামাত এবং মানবতাপরাধি ঘাতক কামরুজ্জামানের স্বজনেরা। অনুষ্ঠানটি স্পন্সার করে সুইডিশ গ্রিন পার্টির পার্লামেন্টমেম্বার মেহমেত কাপলান। কাপলান সুইডেনের মুসলিম কাউন্সিল এবং যুব মুসলিমের ফর্মার স্পোকসম্যান। অনুষ্ঠানে ব্রিটেন থেকে কি স্পিকার হয়ে আসেন সিলেট বংশোদ্ভুত আজমল মাসুর ব্রিটিশ পলিটিশিয়ান এবং ইমাম, ব্যারিস্টার জন স্টেফান ক্যামেখ এবং ব্যারিস্টার আবু বকর মোল্যা।
‘বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক এই সেমিনারের বিষয় এবং আয়োজকদের পরিচয় জেনে অনেকটা শেষ মুহূর্তে আমরা কজন এখানে অংশগ্রহণ করি। আমাদের আমন্ত্রণ জানান সুইডিশ এমপি কাপলান। শুরুতেই আমরা বুঝতে সক্ষম হই জামাতের এই ধূর্ত চক্র ‘মানবাধিকার’ শব্দটি ব্যাবহার করে এখন সুইডিশদের কাছে যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে ভুল তথ্য প্রদান করে তাদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্বল্পসময়ে আমাদের প্রস্তুতি হলো, মানবতা শব্দটি ঘৃণ্য রাজাকার আলবদর ধর্ষক যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে অপব্যাবহার করে ওয়েস্টার্ন জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার এ ষড়যন্ত্র রুখতে হবে।
যথা সময়ে হাজির হলাম। অন্ধকারে জামাতিদের জন্য কাজ করে যাওয়া বেশ কয়েকটি মুখ দিনের আলোয় পরিষ্কারভাবে দেখার সুযোগ হলো। এদের ফ্যামিলির কিছু হিজাব পরিহিতা নারীও অংশগ্রহণ করেছে দেখলাম। এদের কারোরই মুখে নৈতিক দৃঢ়তা নেই। বরং বসলো সব গুটিসুটি মেরে।
ব্রিটিশ ধূর্ত পলিটিশিয়ান সিলেট বংশোদ্ভুত আজমাল মাসুর তার বক্তব্য শুরু করে ডিফেন্সিভ ওয়েতে। তখনও তার আইডিয়া নাই সেখানে বসে আছে মুক্তিযুদ্ধের কিছু নিবেদিত প্রান এবং তার এই খোলা মাঠে ফাঁকা গোল দেওয়ার এই গেম মাত্র সেই মুহূর্তেরই খেলা। স্থুল এবং খুব হালকা শ্যালো যুক্তিকে সম্বল করে সে অত্যন্ত রেটরিক কলায় ধূর্ত কৌশলে তার বক্তব্য শুরু করে। সেমিনারের মুল প্রতিপাদ্য বিষয়ের পরিবর্তে হাসিনা সরকারের মুন্ডুপাত স্থান পায় সর্বাগ্রে। ’শাহবাগি’ মুন্ডুপাত। ‘নাস্তিক’ ‘আল্লাহ এবং রাসুলুল্লাহর অবমাননা’ বহুল শ্রুত প্রপাগান্ডা। শাপলা চত্বর। হেফাজতি। একরাতে আড়াই হাজার হেফাজতি হত্যা। ইত্যাদি বিষয় স্থান পায়।
মাশুরের সমস্ত বক্তব্যজুড়ে স্থান পায় যুদ্ধাপরাধিীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা ‘সেসব ভুয়া মামলা’ এবং একটি মামলায়ও কোন এভিডেন্স নাই যা দিয়ে প্রমান হবে যে এরা যুদ্ধাপরাধী। যে সব সাক্ষী সাক্ষী দিয়েছে তারা কারো কাছ থেকে শুনে এ সাক্ষ্য দিয়েছে বলে মাসুর উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করাই তাদের একমাত্র ৭১ এর ভুমিকা এবং পলিটিক্যালি মোটিভেটেড এই মামলা এবং ট্রাইবুনাল একটি প্রহসন। এটা হাসিনা সরকার একটি ‘শাহবাগী’ প্রডাক্ট।
মাসুর এ ট্রাইবুনালের বিচারিক অথরিটি কমপিটেন্স এবং সবচ্ছতাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে বলেন এটি সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী সরকারের পলিটিক্যাল গেম শুধুমাত্র কিছু মানুষকে ফাঁসি দিতে হবে সেজন্যই এ বিচারিক প্রহসন। এক পর্যায়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ৩০ লক্ষ শহিদ হওয়াকে টোটাল জোক বলে বলেন খুব জোর ৬০ হাজারের মত মানুষ এখানে নিহত হতে পারে।
অডিয়েন্সে তখন অনেকের হাত উঠেছে। এই প্রথম মাসুর বুঝতে সক্ষম হয় অডিয়েন্স তার খোলা মাঠ নয়। কাপলান সকলকে প্রশ্নোত্তর সেকশনের জন্য অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেন।
একে একে সকল বক্তা একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে গেলেন। আর ব্রিটিশ ব্যারিস্টার জন স্টেফান এর ভুমিকা ছিল সবচাইতে নাজুক এবং হাস্যকর। তিনি মিন মিন করে শেখানো যে বুলি দিলেন তিনি ছাড়া আর কারো বোধগম্য হওয়া সম্ভব নয়। হোমওয়ার্ক তিনি করেছেন কিন্তু ভাসমান জ্ঞানে যা বললেন তা হয়ে উঠলো মেউ মেউ মেনু বিড়ালের বিড়বিড় এবং প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নিজের সাফাই গাওয়াই তার সেমিনারের একমাত্র ভুমিকা হয়ে উঠলো। বিনে পয়সায় সুইডেন ভ্রমণ, কিছু সম্মানীর বিনিময়ে ব্রিটিশ হলেও ইসলামের বানী আওড়ে গেলেন তিনি। বাংলাদেশ বিশারদ হয়ার ভান করলেন কিছুক্ষন। তার মূল্যবান বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানেলেন যাতে আমরা আর পেছনের দিকে না তাকাই। ১৯৭১ সাল অতীতের একটা ঘটনামাত্র। আমাদের উচিত এতদিন আগের ঘটনা উন্মোচন না করে সামনের দিকে এগুনো। দেশের কত উন্নতি সংক্রান্ত কাজ রয়েছে সেদিকে নজর দেওয়া। ক্ষমা মহান ধর্ম।
এত হালকা স্থূল এবং শ্যালো নলেজকে অবলম্বন করে তারা একটি সস্তা গেম খেলার একটি প্রচেষ্টা নিলেও সুখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু নিবেদিত প্রান উপস্থিত থেকে এই প্যানেলকে সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রশ্ন করে দুর্বল করে।
উপস্থিত শ্রোতাদের থেকে একজন এই সেমিনারের আয়োজক কাপলানকে এই মর্মে স্মরণ করিয়ে দেন যে আজকের এই সেমিনার নামক প্রপাগান্ডা আয়োজনে যে মিথ্যা এবং অপপ্রচার সর্বপরি মানবতাধিকার অপরাধীদের বাঁচানোর এই অপপ্রয়াসের জন্য আয়োজককেই দায়ি থাকতে হবে। এ সময় এই সেমিনারের আয়োজক কাপলান তার অবস্থান পরিষ্কার করেন এবং ভবিষ্যতে সকল চিন্তা এবং মতাবলম্ববিদের জন্য সেমিনারের সুযোগ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
এ সময় এই সেমিনারের নিন্দা জানান ব্লগার নাদের আহমেদ, আরিফ মাহবুব, আমি শেখ তাসলিমা মুন এবং ডঃ ফরহাদ আলী খান। ডঃ ফরহাদ আলী খান এ সেমিনার বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করে বলেন, এটি কোন অবস্থাতেই সেমিনার বলে গণ্য হতে পারেনা। মূলত মানবতার নামে এখানে একটি বিশেষ মৌলাবাদি গোষ্ঠী, মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী, ১৯৭১ সালে সংঘটিত ৩০ লক্ষ শহীদ এবং ৩ লক্ষ নারী শিশুর ধর্ষণকারী নিকৃষ্ট মানবতা লংঘনকারী অপরাধীদেরই তাদের প্রাপ্য শাস্তি থেকে বাঁচানোর একটি প্রচার অনুষ্ঠান হিসেবে ব্যাবহার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন সেমিনারে মূলত মানুষ সব সময় শিক্ষা এবং ইনফরমেটিভ কিছু জানতে পারে। এটাকে অবশ্যই পলিটিক্যাল প্রচার প্রপাগান্ডা এবং মিথ্যাচার হিসেবে গণ্য করতে হবে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ৩০লক্ষ শহীদের পরিবর্তে ৬০ হাজার মানুষ নিহত উল্লেখের জন্য মাসুরের তীব্র সমালোচনা করেন।
বক্তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের মাধ্যমেই এই নিন্দনীয় সেমিনারের সমাপ্তি ঘটে। আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টানেন এই সেমিনারের আয়োজক সুইডিশ গ্রিন পার্টি পার্লামেন্ট মেম্বার মেহমেত কাপলান।
Category: Community news 1st page, Scroll_Head_Line, ইউরোবিডি কমিউনিটি সংবাদ