সিরিয়ায় হামলা : ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নাকচ,জার্মানির বিরোধিতা, ফ্রান্সের সমর্থন
ইউরো সংবাদ: হঠাত্ করেই পাল্টে গেল সিরিয়ায় হামলাসংক্রান্ত পশ্চিমা শক্তির হিসাব-নিকাশ। গতকাল ব্রিটিশ সংসদে সিরিয়ায় হামলার একটি প্রস্তাব নাকচ হয়ে যাওয়ার পর এই পরিকল্পনা বড় ধরনের ধাক্কা খেল। ওই প্রস্তাব নাকচ হয়ে যাওয়ায় সিরিয়াযুদ্ধে আর শরিক হতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র রাষ্ট্রটি। অন্যদিকে সাম্প্রতিক মার্কিনি আগ্রাসনের অন্যতম শরিক জার্মানিও সিরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে। তবে এখনো হাল ছাড়েনি যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন সীমিত পরিসরে হামলা চালানো হবে।
অন্যদিকে সিরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নেয়ার কথা জানিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ বলেছেন, আগামী বুধবার থেকে হামলা শুরু হতে পারে।
সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও প্রবল মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। দেশটির রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট আইন প্রণেতারা বলছেন, সিরিয়ায় হামলার আগে তারা প্রমাণ চান যে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বাহিনীই সম্প্রতি দামেস্কে রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে। কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া সিরিয়ায় হামলা না চালাতেও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আইন প্রণেতারা।
এদিকে গতকাল প্রকাশিত এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৭৫ ভাগ মার্কিনি চান, কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া ওবামা যেন সিরিয়ায় হামলার সিদ্ধান্ত না নেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন, ন্যাটো এবং আরব লিগের বড় ধরনের সমর্থন ছাড়া বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালানো হলে তা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অবৈধ হবে এবং এতে যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে যেতে পারে।’
এ অবস্থায় প্রবল চাপের মুখে বৃহস্পতিবার রাতে প্রভাবশালী আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে বৈঠকে করে ওবামা সিরিয়ার ব্যাপারে প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করেছেন।
তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক সমর্থন তেমন না জুটলেও হামলার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন ওবামা। পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ভূমধ্যসাগরে পঞ্চম ডেস্ট্রয়ার পাঠাচ্ছেন। এর আগে আরও চারটি রণতরী ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করা হয়েছে। এর প্রতিটিতেই রয়েছে প্রচুর টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই সিরিয়ায় হামলার দিকে ইঙ্গিত করে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, সিরিয়ায় হামলার ব্যাপারে রাশিয়ার সমর্থন পাওয়ার আশা করা ঠিক হবে না। তবে হামলার জন্য মিত্রদের সন্ধান করছেন বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল।
সিরিয়ায় হামলার প্রস্তাব ব্রিটিশ সংসদে নাকচ : ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের সদস্যরা সিরিয়ায় সামরিক অভিযানের বিপক্ষে রায় দিয়েছেন। সিরিয়ায় সামরিক পদক্ষেপের পক্ষে নীতিগত সমর্থনের প্রস্তাবের বিপক্ষে ২৮৫ ভোট পড়েছে। পক্ষে পড়েছে ২৭২ ভোট। ফলে তেরো ভোটে প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়।
এই রায়ের মাধ্যমে সিরিয়ায় ব্রিটিশ সরকারের মার্কিন নেতৃত্বাধীন যে কোনো ধরনের আক্রমণের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি বাতিল হয়ে গেল।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এই রায় ক্যামেরনের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতাও তৈরি হতে পারে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গ্রীষ্মকালীন ছুটির মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এই বিশেষ অধিবেশনের ডাক দিয়েছিলেন। এই অধিবেশনের লক্ষ্য ছিল সিরিয়া প্রশ্নে সংসদে কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় কিনা।
তবে ভোটের এ ফল ডেভিড ক্যামেরনকে ধরাশায়ী করেছে। ক্যামেরন সিরিয়ায় সামরিক অভিযানের পক্ষে বেশ সক্রিয় ছিলেন।
ক্যামেরন বলেন, ‘সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে যে হামলা চালানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া খুবই প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তবে এটা স্পষ্ট যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কোনো ধরনের সামরিক অভিযান চায় না। ব্রিটিশ নাগরিকদের ভাবনাই এ রায়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। আর তাই পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান রেখে সে অনুযায়ী কাজ করবে সরকার।’
ব্রিটিশ সংসদের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত : সিরিয়ায় হামলার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়াটা ছিল ব্রিটিশ সংসদের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। কোনো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সংসদে প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন অথচ সংসদ তা নাকচ করে দিয়েছে—বলতে গেলে এটা প্রায় অচিন্তনীয় ব্যাপার। সর্বশেষ এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল ২৩১ বছর আগে, ১৭৮২ সালে।
তত্কালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তাব ব্রিটিশ সংসদে উত্থাপন করলে এমপিরা তা নাকচ করে দেন।
এবারও একই ঘটনা ঘটল। এবার সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্রস্তাব নাকচ করল ব্রিটিশ সংসদ। তবে এটা ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য। এমনটা যে হতে পারে—ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন হয়তো চিন্তাই করতে পারেননি।
আমেরিকার সঙ্গে সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে শরিক হওয়ার প্রস্তাব সেই ব্রিটিশ সংসদে নাকচ হয়ে গেল, যে দেশটির সঙ্গে আমেরিকা সব সময় ‘বিশেষ’ সম্পর্ক বজায় রাখে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য গভীর বন্ধনে আবদ্ধ।
তবে ক্যামেরনের এই নজিরবিহীন পরাজয় নিয়েও ঘটেছে অনেক চমকপ্রদ ঘটনা। সরকারের শরিক দলের ২৯ এমপিই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। ভোটের সময় হাজির ছিলেন না ১০ মন্ত্রী ও দুই প্রতিমন্ত্রী। এদের মধ্যে দুই মন্ত্রী খোশগল্পে মশগুল থাকায় তাদের বেল বাজলেও শুনতে পাননি।
এ অবস্থায় কপাল পুড়তে পারে হুইপ স্যার জর্জ ইয়ংয়ের। তাকে সরিয়ে দেয়া হতে পারে। কারণ তিনি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট আদায়ে ব্যর্থ হয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্রিটিশ সংসদ সদস্যদের এই ইউ-টার্নের কারণ ইরাকে যুক্তরাজ্যের সামরিক আগ্রাসনে অর্জিত তিক্ত অভিজ্ঞতা। ইরাকের বিরুদ্ধে সর্বশেষ যুদ্ধের সময় বলা হয়েছিল, গোয়েন্দা তথ্যে প্রমাণ মিলেছে দেশটির তত্কালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের হাতে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে।
তবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রমাণ হয় যে, সেই গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল বানোয়াট। কিন্তু ততদিনে সভ্যতার সূতিকাগার ইরাক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ওই মিথ্যা রিপোর্ট নিয়ে ব্রিটিশ সরকার সারা দুনিয়ায় সমালোচিত হয়।
তাছাড়া ইরাক যুদ্ধও ব্রিটিশদের জন্য ছিল এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিকভাবে ব্রিটেন ভয়াবহ সঙ্কটে পতিত হয়। পাশাপাশি বহু ব্রিটিশ সৈন্য ইরাকে নিহত হয়।
হামলায় যোগ দেয়ার সম্ভাবনা নাকচ করল জার্মানি : সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর সামরিক অভিযানে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র জার্মানি।
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী গুইডো ওয়েস্টারওয়েলে দেশটির একটি প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সিরিয়া অভিযানে যোগ দেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই জার্মানির।
পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর অন্যতম প্রভাবশালী দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, এ ধরনের সামরিক হামলার জন্য আমরা কখনও আহ্বানও জানাইনি অথবা এ ধরনের হামলার কথা বিবেচনাও করিনি।
শরিক থাকবে ফ্রান্স : ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ সিরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হামলার পক্ষে জোরালো সমর্থন দিয়েছেন।
ফ্রান্সের লা মদেঁ পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে ওঁলাদ দামেস্কে রাসায়নিক হামলার জন্য আসাদকে দায়ী করে বলেন, তাকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। অন্যথায় অন্য দেশে এই অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি বাড়বে।
তিনি বলেন, হামলা চালানো হলে প্রেসিডেন্ট আসাদ বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনায় বাধ্য হবেন। আগামী বুধবারের আগেই সম্ভাব্য হামলার সিদ্ধান্ত এখনও বাতিল করা হয়নি বলে জানান ওঁলাদ।
Category: 1stpage, আন্তর্জাতিক, ইউরো সংবাদ, ইউরো সংবাদ, ইউরো-সংবাদ - France, ইউরো-সংবাদ - German, ইউরো-সংবাদ -UK, শীর্ষ সংবাদ