‘বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী বালিকা’- মালালা ইউসুফজাই
আন্তর্জাতিক: সাক্ষাত্কার অনুষ্ঠানটির শিরোনাম ছিল ‘দ্য ব্রেভেস্ট গার্ল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’—বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী বালিকা। গত শুক্রবার রাতে সিএনএনের চিফ ইন্টারন্যাশনাল করসপন্ড্যান্ট ক্রিশ্চিয়ান আমানপোর ‘বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী এই বালিকার’ সাক্ষাত্কারটি গ্রহণ করেন। সেই সাহসী বালিকার নাম, মালালা—মালালা ইউসুফজাই। কেন সাহসী, কবে থেকে সাহসী—এসব প্রশ্নের উত্তর এখন অবান্তর। সারা বিশ্বের মানুষ জেনে গেছে মালালার সাহসের কথা, তার সংগ্রামের কথা। আমানপোর তার সাক্ষাত্কার অনুষ্ঠান শুরু করেন এভাবে : ‘আজ রাতে আমাদের সামনে থাকছে একটা প্রশ্ন—সাহস কোত্থেকে আসে? যাকে বলে সত্যিকারের সাহস—যা পাল্টে দিতে পারে গোটা পৃথিবী। আজ রাতে এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে রয়েছে ১৬ বছর বয়সী মালালা ইউসুফজাই। তার সঙ্গে রয়েছেন তার আব্বা জিয়াউদ্দিন। আজ রাতে আমি একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। সে প্রশ্নটি হল- পাকিস্তানের এক প্রত্যন্ত এলাকার একটি বালিকা কিভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারল যে, সে তালেবানের রক্তচক্ষুকে পাত্তা দেবে না। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর খুনি লোকজনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এই সাহস মালালা পেল কোথা থেকে?’
এ প্রশ্নের জবাবে মালালা বলল, ‘আমার অধিকার আছে লেখাপড়া শেখার, আমার অধিকার আছে খেলধুলা করার, আমার অধিকার আছে গান গাওয়ার, আমার অধিকার আছে কথা বলার, মার্কেটে যাওয়ার।’ এসময় আমানপোর বলেন, ‘এখন সারা দুনিয়া মালালাকে জানে। কিন্তু তার আগে সে ছিল এক অতিসাধারণ স্কুলছাত্রী। ছোট্ট বালিকা কিন্তু বিরাট স্বপ্ন।’ মালালা জানায়, ‘ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। এটাই ছিল আমার স্বপ্ন। কিন্তু আমার আব্বা আমাকে রাজনীতি করার কথা বলতেন। কিন্তু তখন রাজনীতি আমি পছন্দ করতাম না।’
ক্রিশ্চিয়ান আমানপোর বলেন, ‘মালালা মানে হল, অসাধারণ স্বপ্ন দেখা এক সাধারণ মেয়ের গল্প। সে বুদ্ধিদীপ্ত বালিকা। সে তার বয়সের চেয়ে অনেক এগিয়ে।’ এসময় মালালা বলে, ‘আমি শুধু আমার অধিকারের কথা বলেছি। আমার শিক্ষা লাভের অধিকার, শান্তিতে বসবাসের অধিকার—এসবের জন্যই আমি রুখে দাঁড়িয়েছি।’
আমানপোর বলেন, ‘মালালা যে স্কুলে যাচ্ছে তাতে তার আব্বা জিয়াউদ্দিনের চেয়ে খুশি আর কেউ হয়নি।’ এসময় জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘সে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। বিশ্বাস করুন, আমি তাকে ভালোবাসি, দারুণ ভালোবাসি।’ আমানপোর বলেন, ‘তাদের বাড়ি পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার মিঙ্গোরা শহরে। চারদিকে পাহাড়, স্বচ্ছ পানির ঝর্ণা—প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত তাদের সেই এলাকা। এমনই স্বপ্নের উপত্যকায় দুঃস্বপ্নের মত এল তালেবান। ২০০৮ সাল থেকে এই সুন্দর এলাকাটিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করল তারা। তালেবান যোদ্ধারা এই উপত্যকা দখলে নিয়ে কঠোর শরিয়ত আইন বলবত্ করল। কেউ সে আইন না মানলে বেত্রাঘাত করা হত। হত্যাও করা হয়েছে বহু মানুষ। মালালা নিজের চোখে দেখেছে, তাদের পরিবারের অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর লাশ সাধারণ মানুষের দেখার জন্য ফেলে রাখা হয়েছে টাউন স্কোয়ারে। এ দেখে মালালার সারক্ষণ ভয় হত, তালেবান যোদ্ধারা না জানি তার আব্বুকেও হত্যা করে! কারণ, তার আব্বু ছিলেন তালেবানের একজন বড় সমালোচক।’
মালালা জানায়, ‘আমি ভাবতাম, তেমন হলে আমি বাথরুমে গিয়ে লুকাবো তারপর সুযোগ পেলে পুলিশকে ফোন করব। তারা এসে আব্বুকে বাঁচাবে।’ এসময় আমানপোর বলেন, ‘একরাতে তালেবান কমান্ডার স্থানীয় বেতারকেন্দ্র দখল করে নতুন এক ফরমান জারি করে। তাতে বলা হয়, “১৫ জানুয়ারির পর আর কোন মেয়ে স্কুলে যেতে পারবে না।” ইউসুফজাইরা তাদের স্কুল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন এবং হাজার হাজার মানুষ সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে তাদের প্রাণ বাঁচাল। এরপর কয়েকমাস ধরে তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই হল। শেষে সোয়াত উপত্যকা পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলে আসে। মালালাদের পরিবার ঘরে ফিরল। আবার স্কুলে যাওয়া শুরু হল তার। তবে তখনই সে তালেবানের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হল। একদিন এক তালেবান যোদ্ধা তার স্কুল বাসে উঠে গুলি করল মালালার মাথায়। এর পরের কাহিনী জানে গোটা দুনিয়া। সবাই জানে তার সংগ্রামের কথা। সারা পাকিস্তানে মালালাকে গুলি করার প্রতিবাদে মিছিল হয়েছে, মোনাজাত হয়েছে মালালার সুস্থতা কামনায়।’
এসময় জাতিসংঘের বিশেষ দূত জনপ্রিয় অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি টেলিফোনে বলেন :তালেবান জঙ্গিরা তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। এই ঘটনা তাকে আরো বেশি সাহসী করে তুলেছে।
আমানপোর বলেন, ‘ভাগ্য ভালো যে, জঙ্গিদের বুলেটে তার মস্তিষ্কের কোন ক্ষতি হয়নি। চিকিত্সকরা তার জীবন রক্ষা করেছেন এবং সপ্তাহখানেকের মধ্যে মালালা সবাইকে আশ্বস্ত করেছে যে, সে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।’ এসময় মালালা বলে, ‘আজ আমি আপনাদের সামনে কথা বলতে পারছি। আল্লাহ্ আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।’ আমানপোর বলেন, ‘যে জঙ্গি তাকে গুলি করেছিল, সে এখনো ধরা পড়েনি। এবং এ সপ্তাহেই তালেবান আবার তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। তবে গত জুলাইয়ে জাতিসংঘে ভাষণ দিতে গিয়ে মালালা বলেছে, সে আর জঙ্গিদের ভয় পায় না।’ মালালা এসময় বলে, ‘তারা মনে করে, তারা বুলেট দিয়ে আমাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু তা তারা পারবে না। বরং তারা একজনের কণ্ঠ রোধ করলে হাজার কণ্ঠ সরব হয়ে উঠবে। জঙ্গিরা ভাবে, তারা আমার স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেবে কিন্তু তারা আমার জীবনের কোন কিছুই পাল্টে দিতে পারেনি। অবশ্য একটা কাজ তারা করেছে, সেটা হল এই ঘটনার পর আমার মনে যা কিছু দুর্বলতা ছিল—তার মৃত্যু হয়েছে, যত হতাশা ছিল—সব বিদায় নিয়েছে। আমার মনে জন্ম নিয়েছে নতুন শক্তি, নতুন অনুপ্রেরণা, নতুন সাহস।’
আমানপোর বলেন, ‘সেই দিন, এক বছর আগে যে দিন তোমাকে গুলি করা হয়েছিল—কি ঘটেছিল বাসের ভেতর? একজন লোক বাসে ঢুকে তোমার বান্ধবীর কাছে প্রশ্ন করেছিল, কে মালালা?’ এর উত্তরে মালালা বলে, ‘লোকটা তার প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করেনি। লোকটা একেবারে কাছ থেকে দুইবার গুলি করে। একটা লাগে আমার কপালের বাম পার্শ্বে। এতে আমার কানের পর্দাও ফেঁটে যায়। বুলেটটি কপাল থেকে ঘাড় হয়ে কাঁধে গিয়ে ঢোকে। কানের পর্দা ফেঁটে যাওয়ায় এখন আমার শুনতে কিছুটা সমস্যা হয়। তবে কপাল ভালো বলতে হবে, কারণ বুলেটটি আমার মস্তিষ্কের কোন ক্ষতি করেনি। আমি বেঁচে আছি, কথা বলতে পারছি, হাসতে পারছি। এ জন্য আমি যে কত খুশি—তা বলে বোঝাতে পারব না। বেঁচে আছি বলে আল্লাহ্তায়ালাকে হাজার শুকরিয়া। সারা দুনিয়ার মানুষ আমার জন্য মোনাজাত করেছে, এখনো করছে। তারা আমার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে আসছে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ যার জন্য মোনাজাত করে, আল্লাহতায়ালা সে মোনাজাত কবুল করেন।’ আমানপো জানতে চান, ‘সারা বিশ্বের অসংখ্য মানুষ তোমার জন্য মোনাজাত করেছে, তুমি তাদের উদ্দেশে কি বলতে চাও?’ মালালা জানায়, ‘ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে লাখো লাখো মানুষ আমার জন্য মোনাজাত করেছে। তারা যে ভালোবাসা আমার প্রতি দেখিয়েছে, তাতে আমি আপ্লুত।’
আমানপোর বলেন, ‘তুমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলে। কিন্তু তোমার আব্বা চায় তুমি রাজনীতি করো। সদ্য লেখা তোমার বইতে তুমি বলেছ, বেনজির ভুট্টো তোমার জীবনের এক আদর্শ নারী। তিনি নারী, তিনি প্রধানমন্ত্রী, তিনি তালেবানের হাতে নিহত। বেনজির তোমার আদর্শ। তাহলে তুমি কি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাও?’ এই প্রশ্নের জবাবে মালালা বলে, ‘যখন আমি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম—তখন আমি সোয়াতে বাস করতাম। সোয়াতের বাইরে কখনো যাইনি। সোয়াতের যে সমাজ, সেখানে নারীদের জন্য ঘরকন্যা ছাড়া আর কিছু করার তেমন সুযোগ নেই। রান্না-বান্না কর, সন্তান সামলাও—ব্যাস! বড়জোর ডাক্তার বা শিক্ষক হওয়া যেতে পারে। সে কারণেই আমি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আমাদের ক্লাসের আর সবাইও ডাক্তার হওয়ার কথা ভাবত। কিন্তু বর্তমানে যখন আমি সোয়াতের সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখি, তখন বুঝতে পারি, সরকার সোয়াতের এই সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে কিছু করছে না। আমি এখন বুঝতে পারছি, যদি আমি ডাক্তার হই তবে সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের সেবা করতে পারব। কিন্তু যদি আমি একজন রাজনীতিক হই তবে গোটা দেশের সেবা করতে পারব। আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাই এবং আমি মনে করি, এটাই বেশি ভালো। এর মাধ্যমে আমি গোটা দেশের জন্য কাজ করতে পারব। প্রধানমন্ত্রী হলে আমি হব গোটা দেশের চিকিত্সক। আমি শিশুদের শিক্ষার জন্য কাজ করতে পারব, শিক্ষার মান বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারব। প্রধানমন্ত্রী হলে আমি শিক্ষা খাতে অনেক অর্থ ব্যয় করব।’ আমানপোর বলেন, ‘এখনো কি বিরাট স্বপ্ন তোমার মনে!’ মালালা বলে, ‘ওরা গুলি করে আমার দেহ ক্ষতবিক্ষত করেছে কিন্তু আমার স্বপ্ন দেখাতে আঁচড় কাটতে পারেনি।’
Category: 1stpage, আন্তর্জাতিক, শীর্ষ সংবাদ