• ৪ জ্যৈষ্ঠ ,১৪৩১,18 May ,2024
  • ব্রেকিং নিউজ : বাংলাদেশের রিকশাচিত্র পেল ইউনেস্কোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি

রাশিয়াতে নববর্ষের অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চার

| ডিসেম্বর 25, 2013 | 0 Comments

রাশিয়াতে নববর্ষের অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চার

ইউরো সংবাদ: নতুন বছর এগিয়ে আসছে – ভবিষ্যত উজ্জ্বল আশার এক অপরূপ উত্সব. ১লা জানুয়ারী শুরু হওয়ার আগে রূপকথার রাতে ৩১শে ডিসেম্বর আমরা সকলে, আমাদের জাতীয় পরিচয়, সামাজিক অবস্থান ও রাজনৈতিক পছন্দ ভুলে ঐক্যবদ্ধ এক স্বপ্ন নিয়েই বাঁচি – শুরু হওয়া বছরে আর একটু বেশী আনন্দিত হতে পারার জন্যই.

রাশিয়াতে নতুন বছরের উত্সব পনেরোশ শতকের শেষে পালন করা শুরু হয়েছিল, কিন্তু তা করা হত ১লা জানুয়ারী নয়, ১লা সেপ্টেম্বর. এই দিনটিকে স্থির করেছিলেন মস্কোর তখনকার মহান রাজা তৃতীয় ইভান. তারপর থেকে হেমন্তের প্রথম দিনে মস্কো ক্রেমলিনের প্রধান চত্বরে জনগন জমা হ’তেন, সম্রাট ও তাঁর পারিষদরা উত্সবের পোষাকে প্রাসাদ থেকে বের হ’তেন. অর্থোডক্স গির্জার প্রধান প্যাট্রিয়ার্ক ধর্মীয় প্যারেডের নেতৃত্ব দিতেন আর সেই প্যারেডে থাকত ক্রুশ কাঠ, ধর্মীয় পতাকা ও আইকন. সম্রাটের কাছে পৌঁছে তিনি সম্রাটের সাফল্য কামনা করতেন ও তাঁর স্বাস্থ্য কামনা করতেন. তারপরে শুরু হত উত্সবের উপাসনা, সেই উপাসনা শেষ হলে সম্রাট ও প্যাট্রিয়ার্ক উপস্থিত ধর্মীয় নেতা ও রাজন্য বর্গের কাছ থেকে সম্বর্ধনা পেতেন.

১৬৯৯ সালে দেশের সংস্কার সাধক সম্রাট প্রথম পিওতর ইউরোপীয় সমাজের মতো করে রাশিয়ার জীবনে পরিবর্তন করতে গিয়ে ঠিক করেছিলেন বছর গণনার বিষয়ে একই রকম করার. এর পর থেকে রাশিয়াতে যেমন করা হয়ে এসেছে, সেই রকমের নতুন বছর বিশ্ব সৃষ্টির দিন থেকে গোনা শুরু না করে, ইউরোপের মতই যীশু খ্রীষ্টের জন্ম থেকে গোনা শুরু হয়েছিল. উত্সবের নতুন দিনের কথা পিওতর এক নতুন বিশেষ নির্দেশ দিয়ে স্থির করেছিলেন: “যেহেতু রাশিয়াতে নতুন বছর নানারকম ভাবেই হিসেব করা হয়ে থাকে, তাই এই তারিখ নিয়ে লোকের মাথা খারাপ না করে নতুন বছর সর্বত্র ১লা জানুয়ারী থেকেই হবে. আর ভাল শুরু ও আনন্দের প্রতীক হিসাবে একে অপরকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানানো হবে, আশা করা হবে কাজে সাফল্য ও পরিবারে সুখ-সমৃদ্ধির”.

সম্রাট স্থির করেছিলেন মস্কো শহরে এক অভূতপূর্ব উত্সবের আয়োজন করার. রাত ১২টার সময়ে তিনি রেড স্কোয়ারে হাতে মশাল নিয়ে বের হয়েছিলেন ও নিজে প্রথম হাউই জ্বালিয়ে বাজী পোড়ানোর শুরু করেছিলেন. মস্কোর আকাশ বহু নানা রঙের আগুনে রঙীণ হয়েছিল. উত্সবের বেড়ানো চলেছিল টানা সাত দিন ধরে. এই ভাবেই ১লা জানুয়ারী ১৭০০ থেকে রাশিয়ার ক্যালেণ্ডারে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উত্সব বেশ পোক্ত হয়েই জুড়ে গিয়েছিল.

বিপ্লবের পরে ১৯১৭ সালে সোভিয়েত সরকার নতুন বছরের উত্সবকে বড়দিনের উত্সবের থেকে আলাদা করেই বন্ধ করতে বলে নি. তার ওপরে আবার ভ্লাদিমির লেনিন ব্যবস্থা করেছিলেন শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য “প্রলেতারিয়েতের ফার গাছ” লাগানোর, – উত্সবের সময়ে বাচ্চাদের জন্য সঙ্গীতানুষ্ঠান আর আনন্দের নানারকমের ব্যবস্থা. কিন্তু লেনিনের মৃত্যুর পরে প্রশাসনের এই উত্সবের প্রতি সম্পর্ক খুব কড়া ভাবেই পাল্টে গিয়েছিল: “কমিউনিস্ট বিবেক” নিয়ে যাঁরা জোর দিয়েছিলেন, তাঁরা এটাকে একটা “বুর্জোয়া অবশিষ্টাংশ” বলেই মনে করেছেন. সোভিয়েত দেশের পত্র পত্রিকাতে দেখা গিয়েছিল “শ্রমিকদের তরফ থেকে উষ্মা প্রকাশ করা চিঠিপত্র”, যাঁরা “জঞ্জাল ও নানা রকমের ফালতু জিনিষ দিয়ে ফার গাছ সাজানো বলে” এটাকে উল্লেখ করে, তার প্রতিবাদ করেছিলেন.

১৯৩০এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রশাসন হঠাত্ করেই রাগ বদলে দাক্ষিণ্য দেখিয়েছিল: ১৯৩৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বর দেশের মুখ্য কমিউনিস্ট খবরের কাগজ “প্রাভদা” তে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছিল, যাতে নববর্ষকে আবার করে পালন করার আহ্বান করা হয়েছিল. “সোভিয়েত দেশের বাচ্চা আর দেশের শ্রমিকদের এই রকম একটা দারুণ উত্সবের থেকে কেন বঞ্চিত করা হচ্ছে?”- খুবই করুণ স্বরে এই প্রবন্ধের লেখক তা প্রকাশ করেছিলেন. সেই সময়ে প্রাভদায় বের হওয়া সমীক্ষাকে মনে করা হত দলের নির্দেশ বলেই আর তাই খুবই তাড়াতাড়ি মন্ত্রীসভার নির্দেশ প্রকাশ করা হয়েছিল, যা দ্রুত ও খুবই কঠোর ভাবে পালনের প্রয়োজন ছিল. বলা হয়েছিল “শিক্ষার্থীদের সান্ধ্যানুষ্ঠান করা হবে, যা নতুন ১৯৩৬ সালকে স্বাগত জানানোর জন্য করা দরকার”. দেশের কলকারখানায় নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের নববর্ষের উপহার দেওয়ার জন্য আর বাজারে বিক্রী হতে শুরু করেছিল ফার গাছ. সোভিয়েত খবরের কাগজে, নিজেদের দৃষ্টিকোণ খুবই দ্রুত পরিবর্তন করে নববর্ষের জয়গান গাওয়া শুরু হয়েছিল: সমস্ত উত্সাহ ব্যঞ্জক প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল সেই নিয়ে যে, কি দারুণ আনন্দের সঙ্গে মেলা ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববর্ষ পালন করা হয়েছে. ফলে সোভিয়েত দেশে নববর্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল একমাত্র রাষ্ট্রীয় উত্সব, যা কমিউনিস্ট মতবাদের সঙ্গে জড়িত নয়, আর স্টালিনের শাসনকালে সোভিয়েত দেশের জনগনের একমাত্র উজ্জ্বল মনে রাখার মতো ঘটনা, যা চারপাশের বিষন্ন আবহাওয়াকে কিছুটা হলেও খুশীর আমেজ এনে দিতে পেরেছে.

১লা জানুয়ারী কিন্তু এই দেশে কাজের দিনই থেকে গিয়েছিল, যার ফলে যাদের আগের রাত প্রচুর আমোদ প্রমোদের মধ্যে কেটেছে, তাদের ভোর বেলায় কাজে যাওয়া খুবই মুশকিল হয়ে যেত. তাই ১৯৪৮ সালে সরকার জনগনের কথা চিন্তা করে বছরের প্রথম দিনকে ছুটির দিন বলে ঘোষণা করেছিলেন, যুদ্ধে বিজয় ও দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজের মধ্যে মানুষকে একটু আরাম দেওয়ার চেষ্টা করা সম্ভব হয়েছিল. তারপরে সোভিয়েত দেশ ১৯৯২ সালের মধ্যে চক্রান্তে টুকরো হয়ে দিয়েছিল. সেই ভেঙে ফেলার আনন্দকে মনে রাখতে তখনকার প্রশাসন ২রা জানুয়ারীকেও ছুটি করে দিয়েছিল. আর ২০০৫ সালের পর থেকে দেশে অর্থনৈতিক হাল ফেরার কথা বিচার করে বিশ্বে একমাত্র এই রাশিয়াতেই ১লা থেকে ৫ই জানুয়ারী ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে. ছুটির দিনগুলোকে যোগ করে সারা রাশিয়া এখন এক সপ্তাহের জন্যই ছুটি কাটানো শুরু করেছে, ঠিক সেই পিওতর দি গ্রেটের সময়ের মতো.

কিন্তু এটাই সবকিছু নয়: কারণ রাশিয়াতে এখনও জুলিয়ান ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী ১৩ থেকে ১৪ই জানুয়ারী রাতকে নববর্ষের রাত বলেই ধরা হয়ে থাকে আর ৭ই জানুয়ারী পালিত হয় অর্থোডক্স বড়দিনের উত্সব. ১৩ দিনের এই তফাত ১৯১৮ সালে সোভিয়েত সরকারের করা নির্দেশ অনুযায়ী জুলিয়ান ক্যালেণ্ডার থেকে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেণ্ডারে নিয়ে আসার পর থেকেই শুরু হয়েছে. তাই রুশীদের সবসময়েই “জমানো” থাকে পুরনো নতুন বছরের উত্সব – কয়েকদিন পরের জন্য.

Category: 1stpage, Scroll_Head_Line, ইউরো সংবাদ, ইউরো সংবাদ, শীর্ষ সংবাদ

About the Author ()

Leave a Reply